ইসলামের দৃষ্টিতে হজের আহকাম

9

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

হজের ফরজ তিনটি (১) ইহরাম বাঁধা। অর্থাৎ হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে তালবিয়া পাঠ। (২) উকুফে আরফা (আরফাতে অবস্থান করা। অর্থাৎ জিলহজ মাসের নয় তারিখ সূর্য পশ্চিমে হেলে যাওয়ার পর থেকে ১০ জিলহজ সুবেহ সাদিকের পূর্বের মধ্যে যে কোন সময় এক মুহূর্তের জন্য হলেও আরফা ময়দানে অবস্থান করা। (৩) তাওয়াফে জিয়ারত করা। অর্থাৎ যে তাওয়াফ ১০ জিলহজ সকাল হতে ১২ জিলহজের মধ্যে যে কোন সময় আদায় করা হয়।
আল্লাহর ঘর খানায়ে কাবা আল্লাহর ঘর। অত্যন্ত মর্যাদাবান স্থান। এই ঘরের সোজা উপরে আকাশে আছে বাইতুল মামুর অর্থাৎ ফেরেস্তাদের কাবা। যে ঘরের তাওয়াফ করে সব সময় লক্ষ লক্ষ আল্লাহর ফেরেস্তা। দুনিয়ার মুসলমানগণ খানায়ে কাবার তাওয়াফ করে অর্জন করেন মর্যাদার স্থান। আল্লাহর এই মহান ঘরের তাওয়াফের আছে অসাধারণ ফজিলত। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)হতে বর্নিত প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহ শরীফের ৫০ বছর তাওয়াক করবে যে গুনাহ হতে এমন ভাবে পবিত্র হবে যে দিন তাঁর মা তাকে প্রসব করেছে’। (তিরমজী)
আল্লাহর ঘর খানায়ে কাবার তাওয়াফকারীদের আল্লাহ খুবই ভালোবাসেন, অনুগ্রহ করেন সাথে সাথে তাদের নিয়ে স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক গর্ব করেন। বাইথাকী শরীফে বর্ণিত আছে, মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তাওয়াফকারীদের নিয়ে গর্ব করেন।’
মহান আল্লাহ পাক এমন তাওয়াফের ফজিলত প্রদান করেছেন, যে তাওয়াফের কারণে গুণাহ যত পরিমাণই হোক মার্জনা করে দেওয়া হবে। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণবা করেছেন, মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ এমন দু’ধরণের তাওয়াফ আছে যে তাওয়াফ পাপ যত পরিমাণই হোক তা মার্জনা করে দেন। এর একটি হলো ফজরের তাওয়াফ যা সূর্যোদয়ের সময় শেষ হবে এবং দ্বিতীয়টি হলো আসরের পথের তাওয়াফ যা সূর্যাস্তের সময় শেষ হবে। সাহাবীগণ জানতে চাইলে, ইয়া আল্লাহর রাসুল ! যদি উহার আগেহ বা পরে হয় ? তিনি ইরশাদ করলেন, ‘উহার সাথে মিলিয়ে দেওয়া হবে’। (তাবরাণী শরীফ)
কাবা ঘর তাওয়াফকারীদের আল্লাহর ফেরেস্তারা দোয়া করে থাকেন। এটি মহান আল্লাহ পাক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মহাবিশ্বে মহানবী আশরাফুল আম্বিয়া হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কাবা ঘর আল্লাহর পক্ষে সত্তর হাজার ফেরেস্তা দ্বারা পরিবেষ্টিত। যে ব্যক্তি এই ঘর তাওয়াফ করবে তাঁর জন্য ঐ ফেরেস্তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং কাবার উপরে সালাত আদায় করে (আখবারু মাক্কা লিলফাকিহী : হাদিস নং-৩১৯)
আল্লাহর থাবির জনাবে মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘বাইতুল্লার তাওয়াফ করা সালাতের ন্যায়। কিন্তু তোমরা তাওয়াফের মধ্যে কথা বলে থাক। সুতরাং যে ব্যক্তি তাওয়াফের মধ্যে কথা বলে সে যেন ভালো কথা ব্যতীত মন্দ কথা না কলে।’ (তিরমিজী)
বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন,, প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘ যে ব্যক্তি বাইতুল্লায় তাওয়াফ করে অতঃপর দুই রাকাত সালাত আদায় করে তাঁর একটি গোলাম আজাদ করার ন্যায় হবে’। (ইবনে মাজাহ শরীফ, হাদিসে নং-২৯৫৬)
ইসলামে চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর রাসুল সাাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খানায়ে কাবার রুকনে ইয়ামানীর কাছ থেকে অতিক্রম করে হাজার আসওয়াদের দিকে যেতেন তখন এই দোয়া পড়তেন, ‘আল্লাহুমা ইন্নি আউ’জুবিফা মিনাল কুফ্রি ওয়াল ফাক্করি ওয়ায় যুল্লি ওয়া মাওয়াক্কিফিল খিঝ্ইয়ে ফিদ্ দুনিয়া ওয়াল আখিরাহ, রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসনাতাওঁ ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাওঁ ওয়া ক্বিনা আজাবান নার’। (আখবারু মক্কা লিলফাফিনী: হাদিস নং-১৭১)
হযরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, আমি আল্লাহর রাসুল সাাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহ শরীফের ৭বার তাওয়াফ করে এবং তার হিমের রাখে তাঁর জন্য একটি গোলাম আজাদ করার মত হবে, হাজীগণ পা রাখলে এবং উঠানে উহার বিনিময়ে তাঁর একটি পাট মোচন করে দেয়া হবে এবং একটি সৎকাজ লিখা হবে। (তিরমিজী শরীফ)
হজের আরকান আহকাম সমূহের মধ্যে আল্লাহর স্মরণ বিদ্যমান থাকে। আল্লাহর স্মরণে যে ভাবে আমরা নামাজ আদায় করি তেমনি হজের ঐতিহাসিক স্মৃতির মধ্যে মূলত আল্লাহকে স্মরণ করে থাকি। তাই উম্মুল মোমেনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকী (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে নবীজী ইরশাদ করেছেন, ‘বাইতুল্লায় তাওয়াফ, সাফামারওয়া সায়ী, এবং জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ আল্লাহর জিকিরের জন্য করার নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘ (আবু দাউদ শলীফ)।
আল্লাহ পাক খানায়ে কারার তাওয়াফকারীদের ওপর সবচেয়ে বেশী রহমত করে থাকেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে, আল্লাহ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাক প্রত্যহ ১২০টি রহমত নাজিল করেন। উহার ৬০টি তাওয়াফ কারীদের জন্য, ৪০টি বাইতুল্লাহর চারপাশে অবস্থানকারীদের জন্য এবং ২০টি বাইতুল্লাহর প্রতি দৃষ্টি প্রদানকারীদের জন্য’। (তাবরানী ফিল কাবীর)
অন্য এক হাদিসে মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করে তার পা ব্যথা হয়ে যায় তার বিনিমিয়ে আল্লাহর উপর হক্ব যায় যে, তাকে তিনি জান্নাতের মাঝে আরাম দিবেন’। (আখবারু মাক্কা লিলফাকিহী)
প্রিয নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই তাওয়াফকে গুরুত্ব দিতেন বেশী। তিনি যখন মক্কায় আগমন করতেন তখন তার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিল খানায়ে কাবার তাওয়াফ।
হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)’র অন্যতম দোয়অ যা তিনি হাজারে আসওয়াদ ও মাক্বাস ইব্রাহিমের মাঝখানেও পড়ছেন তা হলো, ‘আল্লাহুম্মা ক্বান্নি’নী বিমা রয়াক্বতানী ওয়া বারিক লী ফিনি ওয়াখলুফ আ’লাইয়া কুল্লা গারিয়াতিন লী বিখইব।’(ইবনু আবী শায়বা)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, পিতার দিকে থাকানো ইবাদত, কাবার দিকে থাকানো ইবাদত, কোরআনের দিকে থাকানো ইবাদত, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা পোষণ করে এমন ভাইয়ের দিকে থাকানো ইবাদতের সামিল। (বায়হাকী)

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক