ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহ.) এর অবদান

46

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম

পাকিস্তানের হাজারা প্রদেশের হরিপুর জেলার শেতালু শরীফে ১৮৫৬ সালে শুভাগমন করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ৩৮তম বংশধর শরীয়ত ত্বরীকতের কান্ডারী, কুতুবুল আউলিয়া গাউসে যমান হযরতুলহাজ্ব আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কুরআনে হিফজ্ সমাপ্ত করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন মাদ্রাসায় কুরআন-হাদিস-এর শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১২৯৭ হিজরি মোতাবেক ১৮৮০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনান্তে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমান। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি সেখানে অতিবাহিত করেন। তিনি শুধু সফল ব্যবসায়ীই ছিলেন না, উপরন্তু, সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে একজন সফল ইসলাম প্রচারক ও প্রথম জামে মসজিদ নির্মাণকারী হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন। আপন পীর ও মুর্শিদ হুযূর খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির নির্দেশে ১৯২০ সালে তিনি রেঙ্গুন গমন করে সেখানকার বাঙালি মসজিদ নামে খ্যাত মসজিদে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব নেন। তাঁর আকর্ষণীয় নূরানী চেহারা, শরীয়ত ও তরীকত বিষয়ে পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান লক্ষ্য করে মুসল্লীরা ক্রমশঃ হুযূর কেবলা সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহির সান্নিধ্যে আসা শুরু করলো। স্থানীয় মুসল্লীরা তাঁকে বাইআত করানোর জন্য পীড়াপীড়ি করলে পীর সাহেব কেবলার ইযাযতক্রমে হাজারো নবী-অলি প্রেমিকদের বাইআত করিয়ে তরিকতের দীক্ষা প্রদান করেনে। তৎকালীন সময় চট্টগ্রামের বহু লোক জীবিকার সন্ধানে রেঙ্গুন তথা সমগ্র বার্মায় অবস্থান করছিল। দৈনিক আজাদী ও কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক, সুফী আবদুল গফুর, ডা. মোজাফফরুল ইসলাম, আবদুল মজিদ সওদাগর, মাস্টার আবদুল জলিলসহ বেশ কিছু চট্টগ্রামের লোক হুজুর ক্বিবলার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।
সাংগঠনিক জীবন: হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির একান্ত ইচ্ছায় ১৯০২ সালে পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশে শাহানশাহ সিরিকোট রহমাতুল্লাহি আলাইহি দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং সুদীর্ঘ ৪০ বছর তা পরিচালনা করেন। সিলসিলা ও তরিকতের খেদমত সাংগঠনিকভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ১৯২৫ সনে বর্তমান মিয়ানমারের রেঙ্গুনে আনজুমানে শুরায়ে রহমানিয়া নামে একটি দ্বীনি তরিকতভিত্তিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। যা ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া নামে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টে রুপান্তরিত হয়েছে। এ সংগঠনের তত্ত¡াবধানে এদেশে শত শত মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ্ পরিচালিত হচ্ছে। আজ এটি শীর্ষস্থানীয় দ্বীনি সংস্থা হিসেবে দ্বীন ও প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।
প্রকাশনায় আত্মনিয়োগ: ইলমে লাদুনীর ধারক হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক রচিত মুহাযিরুল উকূল ফী বায়ানি আওসাফি আকলিল উকূল বা সংক্ষেপে মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামক ৩০ পারা সম্বলিত দরুদ শরীফের অনন্য কিতাবটি প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করে সুদূর রেঙ্গুনে ১৯৩৩ সালে সর্বপ্রথম ছাপানোর কাজ সমাপ্ত করেন। এই কিতাবের প্রতি পারাতে ৪৮ পৃষ্ঠা করে সর্বমোট ১৪৪০ পৃষ্ঠা রয়েছে, সর্বমোট ৬৬৬৬ টি দরুদ শরীফ রয়েছে। প্রতিটি দরুদ শরীফে শানে মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফুটে উঠেছে।
বাংলাদেশে আগমন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে চিরতরে বার্মা ত্যাগ করেন এবং চট্টগ্রামের মুরীদদের অনুরোধে ১৯৪২ সালে বাংলাদেশে আসেন। তার আগেও বার্মা আসা-যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম বন্দরে নেমে ২/১দিন আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় অবস্থান করতেন। ১৯৪২ সাল হতে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত শীতকালীন সময়ে হুজুরকে চট্টগ্রামে আনা হত। এসময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজ, নসিহত সহ সিলসিলার কার্যক্রম করতেন।
অনন্য দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন জামেয়া প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট: ১৯৪৯ সালে বাঁশখালী থানার শেখের খীল এলাকায় হুযূরের খলীফা মরহুম মৌলানা ইজহারুল হক ছাহেব ও মরহুম বজলুল করিমের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত একটি মাহফিলে হুযূর কেবলা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। ত্বাকরীরের প্রারম্ভে সকলকে নিয়ে নবীজীর উপর দুরুদ-সালাম পড়ার মানসে কুরআনুল কারীমের আয়াত “ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইয়ু সাল্লুনা আ’লান নাবিয়্যী ইয়া আইয়ুহাল্লাযিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা” পাঠ করলেন। কিন্তু হুজুর ক্বিবলার সফর সাথীগণ ব্যতীত উপস্থিত জনতার কেউ হুযূর কেবলার সাথে দরুদ শরীফ পড়লেন না। এতে হুযূর কেবলা রাগ¦ানিত ও মর্মাহত হলেন। ক্রোধান্বিত হয়ে সফর সংক্ষিপ্ত করে তিনি শহরে ফিরে আসেন। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, এখানকার সরলপ্রাণ মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা রক্ষা করার জন্য সুন্নীয়ত ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। অতঃপর সকল মুরীদদেরকে ডেকে মাদরাসা করার প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করে বলেন, ‘কাম করো দ্বীনকো বাঁচাও, ইসলামকো বাঁচাও। সাচ্চা আলেম তৈয়্যার করো।’ তিনি ভক্ত অনুরক্তদের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য জমি খোঁজ করতে নির্দেশ দেন। মাদরাসার পরিবেশ কেমন হবে তার বর্ণনা দিয়ে বলেন “এয়সা জাগাহ চাহিয়ে, জো গাঁওভী নেহী, শহর সে দূরভী নেহি,মসজিদ ভী হে, তালাব ভী হে, আনে জানে মে তাকলীফ না হো।” অর্থাৎ শহরও নয়, গ্রামও নয়, সাথে মসজিদ থাকবে, পুকুরও থাকবে।
নিজ পীরের আদেশ বাস্তবায়নের মহা প্রয়াসে দায়িত্বশীল ভক্ত-মুরীদান স্থান নির্বাচনে যারপরনাই তৎপর হয়ে উঠলেন। বেশ কিছু জমি দেখানো হলেও হুজুরের তা পছন্দ হয় না। অনেক অনুসন্ধানের পর হুযুরের বিশিষ্ট মুরীদ নাজিরপাড়া নিবাসী আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম সওদাগর হুযুরকে নিয়ে বর্তমান জামেয়া সংলগ্ন দায়েম নাজির মসজিদের নিকট আসেন। হুযূর সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি জায়গাটি দেখা মাত্রই মুচকি হাসি দিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে বললেন- হ্যাঁ এহি হে, ইসছে ইলম কি খুশবো আরোহিহে” অর্থাৎ এটিই আমাকে দেখানো হয়েছে, এখান থেকে ইলমের সুঘ্রাণ আসছে। হুযুরের অভিব্যক্তি দেখে উপস্থিত মুরিদগণ বুঝতে পারলেন, এ জায়গাটিই তাঁর পরম কাক্সিক্ষত। আর এখানেই মাদরাসার ভিত্তি হতে হবে। তাঁর পরম স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো। তাঁরই পবিত্র হাতে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ধারক-বাহক ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসার ভিত্তি স্থাপিত হলো। আর পরিচালনার দায়িত্ব নিজ হাতে গড়া সংস্থা আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট-এর উপর ন্যস্ত করলেন। বস্তুত এর পিছনে প্রিয় নবী ও আওলাদে রাসূলগণের জাহেরী বাতেনী শক্তিই মূল পরিচালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। হুযূর মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠালগ্নে কয়েকটি অতি মূল্যবান নসিহত করেন। প্রিয় নবী বলেছেন এ মাদ্রাসার ভার তিনি নিজেই নিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ, ইয়ে কিস্তিয়ে নুহ হ্যায়। অর্থাৎ হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম-এর কিসতি সদৃশ, এ মাদ্রাসার খেদমত যারা করবে তারা ঐ কিসতির যাত্রীদের মতো মুক্তি পাবে। হুযূর আরো বলেন ‘মুঝে দেখনা হ্যায় তো, মাদ্রাসা কো দেখো,’ ‘মুঝছে মহব্বত হ্যায় তো মাদ্রাসা কো মহব্বত করো,’ ‘মাদরাসা কি লিয়ে মান্নত করো, মান্নাত পুরো হোনেছে ওয়াদা পুরো করো।’ হুযূরের নির্দেশ বাস্তবায়নে চেনা-অচেনা হাজারো নবী অলী প্রেমিক আল্লাহর বান্দা লক্ষ লক্ষ টাকা দান খয়রাত করে যাচ্ছে এবং তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করছে। বর্তমান সময়ে এ জামেয়া আহলে সুন্নাত ওয়া জামায়াতের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মসলকে আলা হযরতের উপর এই মাদ্রাসার কার্যক্রম বিস্তৃত। বর্তমানে আধ্যাত্মিক জগতের মহান দিকপাল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মাদ্দাযিল্লুহুল আলী) ও আল্লামা পীর সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ (মাদ্দাযিল্লুহুল আলী) এর পৃষ্ঠপোষকতায় মাদরাসার সকল কার্যক্রম আরো অনেক ত্বরক্বীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জামেয়া একটি সত্য ও আদর্শের প্রতীকী নাম। এখানে ইসলামী জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ছাত্রদের নেতৃত্বের গুণ, যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনেরও ব্যবস্থা রয়েছে। এ মাদরাসার খ্যাতি ও সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ দক্ষিণ এশিয়ার অনন্য দ্বীনি শিক্ষা নিকেতনে উন্নীত হয়েছে। কিশতিয়ে মূহ উপাধী লালন করে পথহারা ও সত্যাদর্শ বিমূখ মানুষকে কিয়ামত অবধি মুক্তির কান্ডারী ভূমিকায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
হারামাইনে শরীফাইনের যিয়ারত : হুযূর কেবলা শাহেনশাহে সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৯৪৫ সালে এবং ১৯৫৮ সালে জাহাজযোগে হজ্ব পালন করেন। এই সময়ে মদীনা মুনাওয়ারা, সাহাবায়ে কেরামদের মাজার সহ গুরুত্ববহ স্থান সমুহ যিয়ারত করেন।
এই মহান অলীয়ে কামেল দ্বীন ও মাজহাব মিল্লাতের বৃহত্তম খেদমত আঞ্জাম দিয়ে প্রায় ১০৯ বছর বয়সে ১৩৮০ হিজরির ১১ ই জিলক্বদ মোতাবেক ২৫ শে মে ১৯৬১ খৃষ্টাব্দে রোজ বৃহস্পতিবার ইহ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মহান রবের সান্নিধ্যে গমন করেন (ইন্না ল্লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)।

লেখক : আরবী প্রভাষক,
খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া