আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে; অতঃপর

3

কিংবদন্তী গায়ক মরহুম আব্বাস উদ্দিন আহমদের এই গানটি বাঙালি মুসলমানদের প্রাণ স্পর্শ করেছিল। বিশেষ করে খরা, তাপপ্রবাহ ইত্যাদি কারণে মানুষের প্রাণে বেজে উঠে। শতবর্ষ পুরোনো এই গানটির আবেদন সামান্যতম ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশে উচ্চতা বৃদ্ধি ও খরার কারণে এই মর্মস্পর্শী গানটি সামাজিক মাধ্যমে উচ্চারিত হতে দেখা যায়। তাপমাত্রা অতীতের সকল রেকর্ড ছাপিয়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস বিরাজ করছিল। এমতাবস্থায় কিছু উৎসাহী ব্যক্তি ও সংগঠন (ছাত্র সংগঠনসহ) দেশে লক্ষাধিক গাছ লাগানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। আবার অতি উৎসাহীরা কোথাও কোথাও বৃক্ষরোপণ করে ফলাও করে প্রচার করে। এ হচ্ছে লোক দেখানো এবং হাস্যকর উদ্যোগ। এরা জানে না, বৃক্ষ রোপনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় আছে বর্ষায় বৃক্ষরোপণ করার প্রকৃত সময়। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ বৃক্ষরোপণ হয়ে থাকে। তার কয়টি বেঁচে থাকে। শুধু বৃক্ষরোপন করলেও বৃক্ষ বেঁচে থাকে না। তারজন্য চাই পরিচর্যা ও যত্ন। একটি শিশুকে যেভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যতœ ও পরিচর্যা প্রয়োজন তেমনি বৃক্ষদের বেঁচে থাকার জন্য পরিচর্যা প্রয়োজন। একটি দেশে আদর্শ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য চাই ২৫ শতাংশ বনায়ন থাকা আবশ্যক। সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থা দাবি করে যে দেশে প্রকৃতি বনায়ন আছে মাত্র ১০ শতাংশ। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে বনায়নের হার মাত্র দুই শতাংশ। অভিযোগ আছে যে বন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অবাধে বৃক্ষ নিধনে যুক্ত। সে সুযোগে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠি অবাধে বৃক্ষ নিধন করে যাচ্ছে। উন্নয়নের নাম দিয়ে অবাধে বৃক্ষ নিধন বাংলাদেশে একটি প্রচলিত ধারনা। উন্নতদেশগুলোতে বৃক্ষ না কেটে উন্নয়ণ চলমান। প্রয়োজনে তার পরিকল্পনার আওতায় কোন বৃক্ষ থাকে, তখন তারা আধুনিক পদ্ধতিতে উক্ত বৃক্ষঅন্যত্র সরিয়ে বৃক্ষটি বাঁচতে সাহায্য করে। এ দৃশ্য বাংলাদেশি আমলা ও কর্তাব্যক্তিদের চোখে পড়ে না। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের র‌্যাম্প নির্মাণের জন্য টাইগারপাসে বৃক্ষ কাটার উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। চাটগাঁবাসীর তীব্র প্রতিবাদে তা অবশেষে ক্ষান্ত হয়। এই সুবাদে টাইগারপাস স্কুলের সবগুলো বৃক্ষ কেটে সাবাড় করে একটি গোষ্ঠি ভুয়া কাগজপত্র করে। এই হচ্ছে আমাদের মানসিকতা, এ প্রেক্ষিতে একটি গাছ মানবজাতির জন্য কী উপকার করে তার ফিরিস্তী দেয়া যাক। একটি গাছ বছরে ৬০ পাউন্ডের বেশি ক্ষতিকারক গ্যাস বাতাস থেকে শুষে নেয়। বৃষ্টির পানি শোধন করে ৭৫০ লিটার। ১০টি এয়ার কন্ডিশনারের সমপরিমাণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান সে পৃথিবীতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। যা থেকে আমরা নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি।
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েই চলছে। যার প্রতিফলন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত গরম অনুভূত হচ্ছে। আবার অন্যদিকে বিশ্বের মরু অঞ্চলের দেশসমূহের দেশে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বন্যা ও ভুমিধস দেখা দিচ্ছে। বলা চলে, মরুঅঞ্চল ক্রমে ক্রমে সবুজ হয়ে উঠছে। প্রকৃতির এ পরিবর্তন চলতে থাকবে যতদিন না বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসের উদ্যোগ নেয়া না হয়। জৈব জ্বালানি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববাসী বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসে আরও আন্তরিক ও যত্নবান হতে হবে। যদি আন্তরিক না হয়, তবে ভূপৃষ্ঠ উষ্ণতায় তেতে উঠবে সন্দেহ নাই বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যে দেশগুলো বেশি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে যাক; এবারের তাপ প্রবাহে অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর কাছে সমর্পন করতে দেখা যায়। তাই সকলের হৃদয়ে ধর্মমত অনুসারে আকাক্সক্ষা ছিল হে সৃষ্টিকর্তা / আল্লাহ আমাদের মেঘ দাও, পানি দাও। প্রায় ১৪শত বছর আগে বৃষ্টির জন্য মহান আল্লাহর কাছে আর্তি জানিয়েছিলেন মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স.)। কোরানিক ইতিহাসে দেখা যায় যে, আগেকার নবীগণও মেঘ বৃষ্টির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মুসলমান সমাজে তাদের প্রিয় নবীর(স.) দেখানো পথিধরে ইস্তিসকার নামাজ আদায় করার রেওয়াজ। আজ থেকে ৭০ বছর আগেও দেখেছি বৃষ্টির জন্য কামেল বুজুর্গবা ইসতিসকার নামাজ আদায় করে বাড়ি যাওয়ার আগেই বৃষ্টি নেমে এসেছিল। কিন্তু এখন তেমনটি দেখা যায় না। আমাদের সমাজে অধর্ম ও হারাম উপার্জনের মাত্রা বেড়ে গেছে শতভাগ। খালেস নিয়তে আল্লাহভীতি ও আরাধনা অপর্যাপ্ত থাকার কারণে এখন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা ব্যর্থ হয়। অপরদিকে একদল নামধারী মুসলিম ফেয়াক, কৌতুক ও টিটকারী করতে দেখা যায়। যা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যই বলা যায়।
যাই হোক, আসুন আমরা প্রকৃতভাবে মহান আল্লাহর বন্দেগী করি, পাপাচার থেকে মুক্ত থাকি এবং সর্বোপরি হালাল রিজিকের অনুসন্ধান করি। দুর্নীতি, ঘুষ ও পাপাচার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখি। ‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ হয়ো না’। কোরআনে এই বাণীকে হৃদয়ে ধারণ করি।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)