আরব বসন্ত থেকে বাংলা বসন্ত

4

ডা. হাসান শহীদুল আলম

(৪র্থ র্পব)
ছাত্রদের আন্দোলন কিভাবে হলো : আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ২০১৩ সালের জুলাইয়ে। তখনই সরকার প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ঘোষণা করেছিল ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষার সময়। ছাত্ররা প্রতিবাদ করেছিল। ছাত্রলীগও পাল্টা প্রতিবাদ করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আমজাদ হোসেন তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। ১৪ জুলাই ২০১৩ সালে ৩৪তম বিসিএস এর ফলাফল প্রকাশিত হয়। তখনো ভাংচুর হয় সরকারি সম্পত্তি।প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, আমাদের কাছে ছবি আছে, যারা ভাংচুরের সাথে জড়িত তাদের নাম পিএসসি তে দেয়া হবে তারা যেন আর কখনও চাকুরী না পায়।আন্দোলনটি শুরু করেছিল জামাতে ইসলামী। ঘটনার সমাপ্তি ঘটিয়েছিল অন্য একটি ঘটনায়। জামাতের বহু নেতাকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। তাই সাধারণ ছাত্রদের দাবির মেধা মূল্যায়ন মঞ্চ শিগগিরই রূপ নিয়েছিল শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে।সেটাও ছিল জুলাই মাস। এরপর আবার ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আন্দোলনকারীদের তালেবান ও বোকো হারাম (নাইজেরিয়ান একটি ইসলামিক দল) দলের মতো বলে তিরস্কার করেছিলেন। তখন ২ জুলাই ২০১৮ইং তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কোটা আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে। উদ্বিগ্ন অভিভাবকের ব্যানারে শিক্ষক ও অভিভাবক রাস্তায় এসে দাঁড়ালে প্রধানমন্ত্রী পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে কারো কোটা থাকবে না।’ ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাহী বিভাগের একটি পরিপত্রের মাধ্যমে সরকারি নিয়োগে কোটা বাতিল করা হয়। ২০১৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত কোন কোটা সংরক্ষণ করা হয়নি।পরিপত্র জারি হলো তিন বছর পর ২০২১ সালে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান হিসাবে কয়েকজন এই পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রীট করলে হাইকোর্ট থেকে পরিপত্র বাতিল করে কোটা বহাল রাখার আদেশ হয়।
সরকার তিনদিনের মধ্যে সেই আপীলের বিরুদ্ধে আপিল করলে আদেশ স্থগিত করে আদালত থেকে শুনানীন দিন ধার্য করা হয়। এখানে সরকারের অনুরোধ ছিল আদালতের মাধ্যমে আদেশ হবে এবং আইনমন্ত্রী বলেছিলেন আশা করা যায় শিক্ষার্থীরা হতাশ হবে না। গত ৫ জুন ২০২৪ হাইকোর্ট সেই ২০১৮ সালের পরিপত্রটি বাতিল করেন।বলাবাহুল্য সরকারের পক্ষে এটর্নী জেনারেলের অফিস থেকে একজন ডেপুটি ও কয়েকজন সহকারী এটর্নী জেনারেল এ নিয়ে লড়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী চীন সফরের উপর সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিকের লিডিং প্রশ্নকে মুখে উচ্চারন করে পাল্টা প্রশ্ন করেন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে। এরপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত রাখার একটি জনপ্রিয় শ্লোগানকে বিকৃত করে রাজাকার শব্দটি বসিয়ে নেয়। আন্দোলনটি তার রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে ধ্বংসে উন্মত্ত সরকার হঠানোর একটা আন্দোলনে পরিনত হয়। তখন ৫ জুন ২০২৪ ইং দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রিট করেন আহিদুল ইসলাম এবং অন্যরা। ১৫ জুলাই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১৬ জুলাই আন্দোলনটি ধবংসযজ্ঞে পরিনত হয় যখন শিক্ষার্থীরা দেশ জুড়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছিল।
১৬ জুলাই আবু সাঈদ গুলিতে নিহত হন। রাজনৈতিকভাবে প্রশিক্ষিত তৃতীয় শক্তি ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে এবং তাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত ক্যাডার ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করতে শুরু করে। সন্ত্রাসী দিয়ে রামপুরা টিভি ভবন, বনানীর সেতুভবন, বিআরটিএ ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, ওয়াসা শোধনাগার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিটিআরসির ডেটা সেন্টার, মেট্রোরেল মিরপুর রেলষ্টেশন, এক্সপ্রেসওয়ে এর টোল প্লাজা, হানিফ ফ্লাইওভার টোলপ্লাজা, ঢাকার সব পুলিশ বক্স, ফুট ওভারব্রীজ ইত্যাদি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কায়দায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারকার করে দেয়া হয়।

আন্দোলন বেহাত হলো কিভাবে : মিশর, লিবিয়া ও তিউনিশিয়ার মতো ‘আরব বসন্ত’ আন্দোলন বাংলাদেশেও আমদানী করে সরকার ফেলে দেয়ার পরিস্থিতি তৈরী করার জন্য বিরোধী দলগুলো যে চেষ্টা চালাচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলি সে কথা আগেই জানিয়েছিল (সময়নিউজ ডট কম, ১০-১২-২৩)। পিটার হাস এর কর্ম তৎপরতার পর থেকেই বাংলা বসন্ত এর প্রস্তুতি শুরু হয়। সিআইএ এর এজেন্ট ‘রেজিম চেঞ্জার’ নামে পরিচিত ডোনাল্ড লু বিশেষ কিছু এজেন্ডা নিয়ে ৩০শে মে, ২০২৪ বাংলাদেশ সফরে আসেন। যখন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত রাখার একটি জনপ্রিয় শ্লোগানকে বিকৃত করে রাজাকার শব্দটি বসিয়ে নেয় তখন থেকেই আন্দোলনটি তার রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে সরকার হঠানোর একটা ধবংসাত্মক আন্দোলনে পরিনত হয়। আন্দোলনের ডিজাইনাররা জানতো যে,রাস্তায় হত্যাকান্ড ঘটলে কন্ট্রোল চলে যাবে মিলিটারীর কাছে। ডিজাইনাররা ছাত্রদের রাস্তায় নামানোর সাথে সমান্তরালভাবে সেনাবাহিনীকে নিজেদের প্রভাবাধীনে নিয়ে গেছে। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ গুলিতে নিহত হন। রাজনৈতিকভাবে প্রশিক্ষিত তৃতীয় শক্তি ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে এবং সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করতে শুরু করে। এভাবে আন্দোলনের ইস্যু যখন সর্বোচ্চ আদালতে গড়ায়, যখন একটি সমাধানের পথ বেরিয়ে আসছিল তখন প্রতিক্রিয়াশীল বিএনপি-জামাত শিক্ষার্থীদের অহিংস কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সরকার পতনের দানবীয় রূপ দান করে। সরকার ও আইন-শৃংখলা বাহিনী প্রথম দিকে আন্দোলনকারীদের ধৈর্য্য ও সহনশীলতার সংগে বোঝাতে চেষ্টা করলেও বিএনপি-জামাতের অবস্থান ও উসকানি সরকার বুঝতে পেরে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করে। তা না করলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব ও সরকার পতনের নানা মাত্রিক মিথ্যাচার আরো ভয়ংকর বিপদের কারন হয়ে দাঁড়ায়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। একটি মিলিটারী হেলিকপ্টার নিয়ে ভারতের দিকে আসেন। শুধুমাত্র ছাত্র আন্দোলন দ্বারা এই পরিস্থিতি তৈরী হয়নি। এটা আসলে ছাত্র নিয়ন্ত্রণাধীন আন্দোলন ছিল না। আন্দোলনের গতিপ্রবাহ দেখে মনে হয় এটি কোন বিপ্লব নয়, খাঁটি অর্থে গণবিদ্রোহ বলা যায় না।বরং বলা চলে পরাশক্তিসমূহের মদতপুষ্ট বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত কোন বাহিনীর সশস্ত্র অভ্যুত্থান।
এখন যে প্রশ্নগুলি সামনে এসে দাঁড়ায় : (১) পেছনে কোন শক্তি না থাকলে এতো অল্প সময়ে এমন সুপরিকল্পিতভাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় কিভাবে হামলা করা হলো ? (২) যারা হামলা করেছে তারা যে এরুপ ধবংসযজ্ঞ চালানোর জন্য প্রশিক্ষিত ছিল তা নিশ্চিত।এগুলো আইএসআই প্রশিক্ষিত জামাতের ক্যাডার বাহিনী ছিল এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। (৩) স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জাতীয় টেলিভিশন ভবনে এমনি আগুন কখনও দেয়া হয়নি। (৪) ফাইবার অপটিক পুড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য কি ছিল ? (৫) নরসিংদিতে কারাগার ভেংগে জংগীসহ অনেক কয়েদী পালিয়েছে। সংগে লুট হয়েছে অস্ত্র। পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া এমন জংগী ছিনতাই এর ঘটনা ঘটানো সম্ভব কি? (৬) কিভাবে বিক্ষোভকারীরা অস্ত্র পেয়েছিলেন? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক-বিশেষজ্ঞ (অব.) ব্রিগেডিয়ার এম. সাখাওয়াত হোসাইন এ ব্যাপারটা তদন্ত করে মন্তব্য করেছেন যে, যে ধরনের গুলিতে ছাত্ররা নিহত হয়েছে সে ধরনের গুলি পুলিশের কাছে থাকে না এবং পুলিশের কাছে এ ধরনের মরনঘাতী গুলি করার ট্রেনিং বা অস্ত্র কোনটাই নেই। অতএব এই গুলি পুলিশ ছোঁড়েনি। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে এই গুলি কারা ছুঁড়েছে? নিশ্চয়ই প্রশিক্ষিত ক্যাডাররাই ছুঁড়েছে।প্রশিক্ষিত ক্যাডার সরকার দেবার প্রশ্নই আসেনা। যেহেতু সরকারের র‌্যাব,বিজিবি রয়েছে। কারা দিতে পারে এই ধরনের প্রশিক্ষিত ক্যাডার? জামাত-শিবির এবং বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা নয় কি ? বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে পাকিস্তানের আইএসআই যারা আমেরিকার সিআইএর প্রভাবে এবং নির্দেশে প্রশিক্ষিত ক্যাডার দ্বারা এই জঘন্য হত্যাকান্ড চালিয়েছে। (চলবে)
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর
প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম