আরব বসন্ত থেকে বাংলা বসন্ত

3

ডা. হাসান শহীদুল আলম

(৩য় পর্ব)
হাসিনা সরকার কেন পরাশক্তিদের কোপানলে পড়লো ?
ক) বাংলাদেশের নির্বাচনে পরাশক্তিদের হস্তক্ষেপ নূতন নয়। বাংলাদেশের নির্বাচনপূর্ব রাজনীতিতে আঞ্চলিক পরাশক্তির যথেষ্ট প্রভাব ছিল। ১৯৯৬-২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ হাসিনা আঞ্চলিক পরাশক্তিকে তাদের প্রত্যাশিত সবকিছু দিতে রাজি ছিলেন না বলে সেই পরাশক্তি কিংবা তার গোয়েন্দা বাহিনী শেখ হাসিনার উপর খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না। তাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশে প্রয়োজন এমন একটা নতজানু সরকার,যা সবসময় সেই আঞ্চলিক পরাশক্তির নীতিমালা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে বক্তৃতায় বলেছিলেন, সেই আঞ্চলিক পরাশক্তির কাছে গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি না হওয়ায় ‘সিআইএ’ এবং ‘র’ ২০০১ সালে বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছিল।
খ) ‘জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারী ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট বা জিসোমিয়া এবং একুইজিশনস এন্ড ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট’ বা এসিএসএ নামের এই দুই চুক্তির বাইরে এই অঞ্চলে ‘নো ফ্লাই জোন’ প্রতিষ্ঠার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যু সামনে রেখে চাপ প্রয়োগের অপকৌশল নিয়েছিল। সামরিক কৌশলগত এই চুক্তিতে বাংলাদেশ সম্মত হয়নি বিধায় হাসিনা সরকার উৎখাতে বিরোধীদের সহিংস আন্দোলনে সমর্থনসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক অবরোধের চক্রান্তে তৎপর হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
গ) একাধিক মার্কিন কোম্পানী বাংলাদেশে বিভিন্ন রকমের ব্যবসা করতে চায়। কিন্তু এ সব ব্যবসা তারা বাংলাদেশের আইন ও বিধি মোতাবেক করার সুযোগ পাচ্ছে না দেখে তারা এ জন্য মার্কিন রাজনীতিকে ব্যবহার করছে।
ঘ) চীনের সংগে সম্প্রতি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশের।স্বয়ং হাসিনাকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবার বিষয়ে সবুজ সংকেত দিয়েছে চীন।চীনের সংগে চুক্তিতে সায় দেয়া এবং মার্কিন আবেদনকে নাকচ করায় বাংলাদেশের আন্দোলনে সিআইএ নাক গলানোর সুযোগ নিয়েছে।
ঙ) দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার মূল প্রতিদ্ব›দ্বী হলো চীন। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শক্তি ভারত আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু নয়। এই দুটো পয়েন্ট এখানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আমেরিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের সাথে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একই সংগে সম্প্রতি চীনের সাথেও শেখ হাসিনার সম্পর্ক মজবুত হয়ে উঠছিল। ‘স্টুডেন্ট এক্সেস’ পরিকল্পনা অনুযায়ী চীন ইউনান প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রচলন করেছিল।চীনের অফিশিয়াল লেংগুয়েজ ’মান্দার’ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শেখানোর প্রচলন করা হচ্ছিল।
চ) বাংলাদেশ ব্রিকস-এ যোগদানের ঘোষনা দিয়েছে। যা ভারত-মার্কিন বলয়ের পছন্দ হয়নি। চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়াকে সাদা মনে গ্রহন করেনি পশ্চিমারা। তাই ইন্দো-প্যাসিফিক জোট করে বাংলাদেশকে সেই জোটে যুক্ত করতে চাইছে পশ্চিমারা।
ছ) চীনের উদ্দেশ্য : (১) চীনের গড় বয়স বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু অসংখ্য কল-কারখানায় অসংখ্য শ্রমিকের প্রয়োজন। বাংলাদেশ থেকে সস্তায় শ্রমিক নেয়া যাবে। (২) বিপুল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের পন্যের বাজারে চীন নিয়ন্ত্রন নিতে চায়। (৩) বঙ্গোপসাগরে চীন সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে চায়। মালাক্কা প্রনালী দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে মালয় উপদ্বিীপ এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত একটি সংকীর্ন ৮০৫ কিমি সমুদ্র প্রনালী। প্রনালী হলো দুটি নদী বা সমুদ্রের সংযোগকারী সংকীর্ন জলপ্রবাহ বা জলধারা। বঙ্গোপসাগর দিয়ে চীনের সী-রুটে মালাক্কা প্রনালীকে বøক করার জন্য আন্দামানে ভারত যেভাবে সামরিক ঘাঁটি তৈরী করেছে তার পাল্টা হিসাবে বাংলাদেশে চীন সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে চায়। কিন্তু শক্তিশালী চীন আমেরিকার জন্য ভয়ের কারন। আমেরিকার স্বার্থ হচ্ছে : (১) চীন দক্ষিন চীন সাগরে যে কর্মকান্ড চালাচ্ছে তার উপর নজর রাখা। এ জন্য আমেরিকার হংকং এর দরকার ছিল। কিন্তু হংকং আমেরিকার হাত থেকে বেরিয়ে গেছে।ভিয়েতনামের সাথে ভারতের সম্পর্ক পাকা। মায়ানমারের সামরিক সরকার চীনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এ জন্য বঙ্গোপসাগরে একটি সামরিক ঘাঁটি তৈরী করার জন্য আমেরিকা মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু হাসিনা সরকারকে একাধিকবার বলেও এ ব্যাপারে রাজি করাতে পারেনি। আমেরিকা বলেছিল সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তাদের দেয়া হোক। সেখানে আমেরিকা সামরিক বেইজ তৈরী করবে। আর তার বদলে হাসিনা যতোদিন খুশি বাংলাদেশে রাজত্ব করুক তাতে আমেরিকার কোন বাধা থাকবে না। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ আমেরিকাকে দেয়া হাসিনা সরকার কোনভাবেই রাজি হয়নি। আর অন্যদিকে চীনের সাথে হাসিনা সরকার সম্পর্ক মজবুত করতে শুরু করে। এটাই আমেরিকার অসন্তুষ্ট হবার কারণ।
যেহেতু এটি আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং এর জন্য ভারতের বিরুদ্ধেও যেতে হতে পারে। কিন্তু ভারতের মতো এতো শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে যাওয়া তত সহজ কাজ হবে না বিধায় আমেরিকার প্ল্যান হচ্ছে ভারতের সেনাবাহিনীকে তিনভাবে বিভক্ত করে রাখা যাতে ভারত দূর্বল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের শাসন পরিবর্তন করে আমেরিকা তাদের সেই লক্ষ্য পূরণ করতে চায়।
জ) চীনের সংগে হাত মেলালেও ক‚টনীতির প্রশ্নে শেখ হাসিনা বরাবর ভারতকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন।ভারতবিরোধী শক্তিগুলিকে কড়া হাতেই নিয়ন্ত্রনে রেখেছিলেন তিনি। সরকারের এই নীতিকে ভাল চোখে দেখেনি ড্রাগন শক্তি। বেজিং চেয়েছিল ঢাকায় ভারতবিরোধী এক পুতুল সরকার বসাতে। সেই লক্ষ্য পূরণে তাদের হাতিয়ার হয়ে উঠে জামাত।
ঝ) বাংলাদেশের কুকি ন্যাশনাল আর্মির সাথে কুকি-চীন আর্মিকে সংগঠিত করে একটা খৃষ্টান দেশ বানানোর প্ল্যান করছে আমেরিকা। পূর্বে ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুরে একটি স্বাধীন খৃষ্টান দেশ গঠন করা হয়েছিল আমেরিকার ইন্ধনে। শেখ হাসিনা কিন্তু এ ব্যাপারে জনগণকে আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে একটি স্বাধীন খৃষ্টান দেশ তৈরী করা হবে। সেই খৃস্টান দেশে আমেরিকা স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি তৈরী করতে থাকবে যাতে সেখান থেকে ভারত এবং চীনের উপর নজরদারী করতে পারবে।মিয়ানমারেও খোলা প্রবেশাধিকার পাবে এবং দক্ষিন চীন সাগর স্পষ্ট দেখতে পাবে এবং সেখানে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। খৃষ্টান রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্ব ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো প্রতিরক্ষাবলয় তৈরী করতে চায়।
ঞ) বাংলাদেশে এয়ার বেজ বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের যা শেখ হাসিনা নাকচ করে দিয়েছিলেন।
ট) সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দুরে আট বর্গ কিলোমিটারের একটি ছোট প্রবাল দ্বীপ। এই দ্বীপে মার্কিন সেনাঘাঁটি বসাতে চেয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বার্মা এলাকা দিয়ে চীন যে রুট তৈরী করছে সেই বিবেচনায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপটিকে আমেরিকা গুরুত্বপূর্ন মনে করছে দক্ষিন এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে নজরদারীর স্বার্থে। সেনাঘাঁটি বানানোর মার্কিন আর্জি খারিজ করে দিয়েছে বাংলাদেশের হাসিনা সরকার। এমতাবস্থায় বিষয়টিকে মোটেই ভালভাবে নেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পেন্টাগণ। পেন্টাগণ হলো মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর ভবন। উল্লেখ্য পেন্টাগণে অবস্থিত আমেরিকার তিন ধরনের মিলিটারী সার্ভিস। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলে সেন্ট মার্টিন বা হাতিয়া পশ্চিমাদের হস্তগত হওয়া সূদূর পরাহত। তাই সিআইএ হাসিনা সরকারের পতন চায়। (চলবে)
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে
স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম