আমাদের ঐতিহ্যের অংশ পুঁথি সাহিত্যের মধ্যে মনসা পুঁথি অন্যতম

5

জোনাকী দত্ত

বাংলার বারো মাসের মধ্যে চতুর্থ মাস শ্রাবণ। বর্ষা ঋতুর এই মাসে বাঙালির নানা পার্বণ পরিলক্ষিত হয়। তার মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মনসা পূজা উপলক্ষে শ্রাবণ মাসের এক তারিখ থেকে পুরো মাস জুড়ে গ্রামে, শহরে মনসা পুঁথি পাঠ উদযাপিত হয়ে আসছে। দেবী মনসা হলেন একজন পৌরাণিক হিন্দু সর্প দেবী। তিনি শিবের স্বীকৃত কন্যা। মনসা, কেতকা, পদ্মাবতী নামেই তিনি সমধিক প্রসিদ্ধ। তাঁর অপর নাম বিষহরি। মনসা নাগরাজ বাসুকীর ভগিনী, ঋষি জরৎকারু মুনির পতœী এবং আস্তিকের মাতা। ভাগবত পুরাণসহ আরও অনেক পুরাণে দেবী মনসার উল্লেখ পাওয়া যায়। হিন্দু শাস্ত্রে আঠারোটি পুরাণ রয়েছে। পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল হচ্ছে তার মধ্যে একটি। এই পুরাণের প্রধান দেবতা সর্প দেবী মনসা। জন্ম সংক্রান্ত কারণে মনসার পূর্ণ দেবীত্ব প্রথমে অস্বীকার করা হয়েছিল। তাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দেবী হিসেবে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করা এবং একটি একনিষ্ঠ মানব ভক্তমন্ডলী গড়ে তোলা। তাঁর সাথে মিশরীয় দেবী আইসিসের মিল রয়েছে। মনসা প্রাক পৌরাণিক দেবী। মনসা সর্প দেবী হওয়ার কারণে স্বর্গলোকে দেবীত্ব লাভে বাধা আসে। দেবাদিদেব মহাদেব শিব মনসাকে বলেছিলেন, তুমি স্বর্গের দেবীত্ব স্বীকৃতি লাভ করতে হলে তোমাকে মর্ত্যের শিবের উপাসক দ্বারা পূজিত হতে হবে।
জনশ্রæতি আছে, চাঁদ সদাগরের সাথে মনসা দেবীর অনেক বিবাদের পর তিনি প্রতিমাসের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে মনসা দেবীর পূজা করতে রাজি হয়। যেহেতু তিনি শিবের ভক্ত ছিলেন সেহেতু তিনি বাম হাতে মা মনসাকে পূজা করেন। এতেই দেবী মনসা সন্তুষ্ট হন। চাঁদ সদাগরের মতো ধনী ও প্রভাবশালী বণিক মনসা পূজা করার ফলে দেবী মনসার পূজা বৃহত্তর জনসমাজে প্রচার লাভ করে। দেবী মনসার বরে চাঁদ সদাগর তার হারানো সবকিছু ফিরে পান এবং সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন। দেবী মনসাকে সন্তুষ্টি এবং সর্প দংশন হতে মুক্তি কামনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনসা পূজা করে থাকেন। মনসা ঘট স্থাপন করে পূজা করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, খ্রিস্টীয় দশম- একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মনসার পূজা প্রবর্তন শুরু হয়।
এই মনসা পূজাকে ঘিরেই আবহমান কাল থেকে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মনসা পুঁথি পাঠ হয়ে আসছে। মধ্যযুগের কবি হরিদত্ত, বিজয় গুপ্ত, কেতকা দাস, ক্ষেমানন্দ, বিপ্রদাস, পিপলাই প্রমুখ রচিত বাংলা সাহিত্যের আলোচিত মনসামঙ্গল কাব্য। এই কাব্যে সে যুগের সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনীতি, আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি ফুটে ওঠে। পুঁথি সাহিত্য আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। শিশু কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়স্ক, বৃদ্ধ সকলের কাছেই পুঁথি সাহিত্যের কাহিনীগুলো ছিল অমৃতের মতো। যিনি পুঁথি পাঠ করতেন তাঁকে ঘিরে সকলেই জড়ো হয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। প্রাচীনকালে যখন ছাপাখানা ছিল না তখনো হাতে লেখা পুঁথির প্রচলন ছিল। প্রাচীন বা মধ্যযুগের প্রায় সকল সাহিত্য হাতে লিখতে হয়েছিল এবং এদের একাধিক সংস্করণও তৈরি হয়েছিল হাতে লিখে। তখনকার সকল সাহিত্যকেই পুঁথি সাহিত্য বলা হয়।এ উপমহাদেশে ত্রয়োদশ শতকের পূর্বে কাগজ ব্যবহারের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। ১৭৭৮ সালে হুগলিতে প্রথম বাংলা ছাপাখানা স্থাপিত হয়েছিল। প্রাচীন হস্ত লিখিত পুঁথিগুলো সাধারণত ভূর্জছাল, কাপড়ের পট, তালপাতায় লেখা হতো। ছাপাখানার ব্যাপক প্রসারের ফলে ঊনবিংশ শতকে পুঁথি সাহিত্যের উন্মেষ ঘটে। ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পুঁথি সংগ্রহ সমিতি’ গঠিত হলে ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর নলিনীকান্ত ভট্টাশীলকে এর সম্পাদক নিয়োগ করা হয়। তার নেতৃত্বে প্রায় ১৭০০০ বাংলা ও সংস্কৃতি পুঁথি সংগৃহীত হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরে পুঁথি সংরক্ষিত আছে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী এ সংখ্যা ৩৪৪১টি।
আগে পুঁথি পাঠের প্রতি মানুষের যে আগ্রহ, ভক্তি ছিল বর্তমানে তা অনেক কমে এসেছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পুঁথি পাঠে তেমন আগ্রহী হচ্ছে না। পুঁথি পাঠ বলে যে একটা লোকজ সংস্কৃতি আছে সেটা অনেকেরই অজানা। এমন এক সময় ছিল যখন ঘরে ঘরে ছিল পুঁথি। রাতে কুপি জ্বালিয়ে শুরু হতো পুঁথি পাঠ। তবে বর্তমানেও কিছু কিছু জায়গায় মনসা পুঁথি পাঠকে ঘিরে নানা আয়োজন করা হয়। পাল্টা পুঁথি পাঠ এখনো জনপ্রিয়।
অধ্যক্ষ রীতা দত্ত দিদিমণির কাছে শুনেছি সারদা সংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় নানা গানের সুরে পুঁথি পাঠের আয়োজন করা হয়। তিনি নিজেও সেই পুঁথি পাঠে উপস্থিত থাকেন। আগে মানুষের ঘরে ঘরে, বাড়ির উঠানে কিংবা মন্দিরে পুঁথি পাঠের আসর বসত। তবে এখনো আমাদের পাথরঘাটায় মাইকে অনেক দূর থেকে পুঁথি পাঠের আওয়াজ কানে ভেসে আসে। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে ভোর পর্যন্ত চলে এই পুঁথি পাঠ। ছোটবেলায় আমি মা, জেঠিমা, বৌদিদের সাথে পুঁথি পাঠে অংশ নিতাম। তখন যে পুঁথি দেখেছি তা দুই পাশে কাঠ আর মাঝখানে পৃষ্ঠাগুলো আলগা। কোন বাইন্ডিং ছিল না। নিউজপ্রিন্টের পৃষ্ঠাগুলো আলাদা আলাদা ছিল, তবে পৃষ্ঠায় সংখ্যা লেখা থাকত। আর ওখানে অক্ষরগুলো স্পষ্ট ও বড় ছিল। আমরা কয়েকজন একসাথে পড়তে কোন সমস্যা হতো না। বিভিন্ন গানের সুর দিয়ে জেঠিমারা যখন পুঁথি পাঠ করত শুনতে এতোই ভালো লাগতো যে শ্রাবণ মাস এলেই দুপুরে আমরা কেউ ঘুমাতাম না। অপেক্ষায় থাকতাম কখন জেঠিমা পুঁথি নিয়ে বসবে। বর্তমানে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। কারো প্রতি আন্তরিকতা নেই, সকলের সাথে বসে আলাপ করার সময়ও নেই। আমার শাশুড়ি আমাকে ‘বাইশকবি শ্রী শ্রী পদ্মপুরাণ’ পুঁথিটি কিনে দিয়েছেন। তবে এটি বইয়ের মতো বাইন্ডিং করা সুন্দর মোড়কে মোড়ানো পুঁথি। আমি প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের এক তারিখ থেকে পড়া শুরু করি। তবে পুঁথি পাঠের আসরের মতো নয়। একা নিজের মতো করে পড়ার চেষ্টা করি। আমার খুব ভালো লাগে।
বাইশ কবি কর্তৃক রচিত ‘বাইশকবি শ্রী শ্রী পদ্মপুরাণ বা মনসা পুঁথি’ হস্ত লিখিত গ্রন্থ বহুকাল ধরে চট্টগ্রামের অধিবাসীগণ শ্রাবণ মাসে প্রতিবছর পাঠ করে আসছেন। কয়েক বছর হলো এই গ্রন্থ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। এই বাইশজন কবির নাম হলো- ১) অনুপ চন্দ্র ২) কমল নয়ন ৩) কেতকা দাস ৪) গোপী চন্দ্র ৫) গোবিন্দ দাস ৬) জানকী নাথ ৭) নারায়ণ ৮) বংশীধন ৯) বংশী দাস ১০) বলরাম ১১) বল্লভ দাস ১২) দ্বিজ বলরাম ১৩) বিজয় গুপ্ত ১৪) বৈদ্য জগন্নাথ ১৫) যদুনাথ ১৬) রঘুনাথ ১৭) রমাকান্ত ১৮) রাধাকৃষ্ণ ১৯) রামনিধি ২০) সীতাপতি ২১) হরিদাস ২২) হৃদয়। এই গ্রন্থ পদ্মপুরাণ অবলম্বনে রচিত। এখানে সব কবিই চট্টগ্রামবাসী বলে অনুমিত। বর্তমানে বহু প্রকার মনসা পুঁথির প্রচলন আছে। প্রথম- বাইশ কবি। দ্বিতীয়- দ্বিজবংশী পদ্মপুরাণ। তৃতীয়- বিজয় গুপ্তের মনসা মঙ্গল। চতুর্থ- যষ্ঠ কবি যা ছয়জন কবি দ্বারা রচিত। পঞ্চম- ক্ষেমানন্দী পদ্মপুরাণ। বাইশ কবির রচনা অতিশয় মধুর ও সর্বজনাদৃত। এই পদ্মপুরাণের শুরুতে সব দেব দেবীর বন্দনা সুন্দরভাবে বর্ণিত আছে। আরো রয়েছে সৃষ্টির প্রারম্ভ, সতীর দেহত্যাগ, চন্ডীর জন্ম, হরগৌরীর বিবাহ, কার্তিক গণেশের জন্ম, নাগমাতা পদ্মা ও নেতার জন্ম ও বিবাহ, ধনঞ্জয় ও আস্তিকের জন্ম, মর্ত্যলোকে চাঁদ সদাগরের সাথে দেবী মনসার বিবাদ, এবং বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের জীবন বৃত্তান্ত ও পদ্মা পূজা প্রকরণ সহ আরো বহু ঘটনা অতি সুন্দরভাবে এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
বর্তমান ভাগলপুর বিভাগের যেখানে গঙ্গার সাথে গন্ডকী নদী মিলিত হয়েছে সেই বিস্তৃত ভূভাগে বহুকাল আগে বসন্ত কেদার নামে এক রাজা ছিলেন। চম্পাকলি নামে এক অসাধারণ রূপবতী নর্তকী নৃত্য গীতের দ্বারা রাজাকে সন্তুষ্ট করায় চম্পাকলির সম্মানার্থে রাজা নিজ রাজ্যের রাজধানীর নাম চম্পাই নগর রাখেন। এর কিছুকাল পর চাঁদ সদাগর ঐ রাজাকে পরাজিত করে চম্পাই নগর অধিকার করেন। সতী বেহুলার সম্মানার্থে আজো প্রতিবছর শ্রাবণ মাসে পৌর্ণমাসিতে বেহুলা মেলা নামে একটি মেলা এখানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বগুড়া সদরের গোকুল নামক স্থানে বেহুলার বাসর ঘর অবস্থিত। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১১ কি. মি. উত্তরে এর অবস্থান। কথিত আছে, কলকাতার কাছে গঙ্গা যমুনা সরস্বতীর মিলনস্থল ত্রিবেণী সঙ্গমে বেহুলা তাঁর স্বামী লহ্মমিন্দরকে নিয়ে কলার ভেলায় ভেসেছিলেন। মনসা মঙ্গল কাব্যে বলা হয়ে থাকে এই ত্রিবেণীর ঘাটেই নেতা ধোপানির সাথে বেহুলার দেখা হয়েছিল এবং তাঁর সাহায্য ও পরামর্শেই স্বর্গে গিয়ে বেহুলা স্বামীর প্রাণ বাঁচিয়ে আনেন। এখনো ত্রিবেণীর ঘাটে গেলে দেখা যাবে নেতা ধোপানির ঘর আর কাপড় কাচার সেই পাথর। এখানকার বাসিন্দারা এখনও সেই পাথরটিকে পূজা করেন। সিলেট তথা হাওর অঞ্চলের বাসিন্দারা দাবি করে আসছেন সুনামগঞ্জ সহ হাওরাঞ্চল একসময় কালীদহ সাগরের নিচে ছিল। পদ্মপুরাণ কাব্যে সেই কালীদহ সাগরের উল্লেখ রয়েছে। ফলে পদ্মপুরাণ এ অঞ্চলেরই কাহিনী। অন্যদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাসিন্দাদের দাবি বাইশকবি পদ্মপুরাণ রচয়িতার প্রায় প্রত্যেকেই চট্টগ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। এ নিয়ে এখনো গবেষকদের মধ্যে পক্ষে বিপক্ষে নানা মতান্তর রয়েছে।
কায়োমনোবাক্যে মনসা দেবীর অর্চনা করলে ইহকালে ধন, সন্তান ও অন্তিমে মোক্ষলাভ হয়। শ্রী শ্রী মা মনসা দেবীর প্রণাম মন্ত্র :
‘আস্তিকস্য মুনের্মাতা ভগিনী বাসুকীস্ততা।
জরৎকারু মুনেঃ পত্নী মনসা দেবী নমোস্তুতে।’
দেবী মনসা সকলের মঙ্গল করুন। সকল অশান্তি, অরাজকতা, হানাহানি, হিংসা বিদ্বেষ, অহংকার দূর হয়ে এই পৃথিবীতে শান্তি আসুক।
লেখক: প্রাবন্ধিক