আবারও প্রতিরোধে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ

2

গতকাল শুক্রবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রামে সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে ডেঙ্গু। চলতি মাসের গত ১১ দিনে চট্টগ্রামের ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৬৬ জন। এসময় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ৫৯৮ জন। সে তুলনায় সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম জেলায় নতুন করে ৩৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের ১১ দিনে ১৬৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১১৫ জন নগরীর এবং ৫১ জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। একই সাথে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। অথচ চট্টগ্রামে চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ৫৯৮ জন।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের গত বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ নিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় তিনদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত তিনজনের মৃত্যু হল। এর আগে সোমবার চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই নারী মারা যান। তাদের মধ্যে একজন নগরীর, অন্যজন কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা। চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গত বুধবার জেলায় মোট ৩৪ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগে মঙ্গলবার ১৬ জন এবং সোমবার নতুন ১২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। চলতি বছর এই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৭৬৪ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ঢাকার পর এই নগরীতেই এডিস মশার ঘনত্ব বেশি। তাই ঢাকার পরই ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস ও সচেতনতা অবলম্বন করা জরুরি।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জেলা কীটতত্ত¡বিদ এন্তেজার ফেরদৌস বলেন, এডিস মশার দুইটি প্রজাতি- এডিস ইজিপ্টি এবং অ্যালবোপিকটাস মূলত ডেঙ্গুর ভাইরাসের জীবাণু ছাড়ায়। আগে অ্যালবোটিকটাস প্রজাতির ঘনত্ব চট্টগ্রামে কম ছিল। তবে গত বছর থেকে দুই প্রজাতির এডিস মশার ঘনত্ব প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই এডিস মশার প্রজনন ধ্বংস করাই এখন একমাত্র জরুরি কাজ। শুধু চট্টগ্রাম নয় এখন রাজধানী ঢাকায়ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। মূলত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। তবে এখন মৌসুমের পরিবর্তনের সাথে ডেঙ্গুর ধরণও পাল্টাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) গত বছর আগস্টের শুরুতেই বাংলাদেশের ডেঙ্গুকে মহামারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল দুই যুগের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২৩ সালে। ঘরে ঘরে জ্বর, মৃতের সংখ্যার রেকর্ড ভেঙেছিল তখন। কিন্তু চিকিৎসা ছাড়া প্রতিরোধ মূলক কোন কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি তখন। এডিশ মশা প্রতিরোধের কথা আসলে সিটি করর্পোরেশনকে আমরা দেখেছি ফগিং মেশিম নিয়ে ক্রাশ অভিযানে বের হতে। অথচ ফগিং দিয়ে যে কাজ হচ্ছে না সেটা আমাদের কর্তাব্যক্তিরা জানার পরও ব্যবহার করে আসছেন। বাস্তবতা হচ্ছে ফগিংয়ের ধোঁয়ায় মশার কিছুই হয় না। বরং উল্টো ড্রেন থেকে উড়ে এসে ঘরের ভেতরে জায়গা করে নেয়। বাজারে পাওয়া যায় বোতল আকারে শক্তিশালী কীটনাশক স্প্রে। সেগুলো বেশ কার্যকর ছিল। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এডিস মশা সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। সচেতন বিশ্বে এক ফরমুলেশন দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয় না। কারণ কীটপতঙ্গ একই ফরমুলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে।
উপায় কী তা হলে? উপায় ডেঙ্গু নির্মূলর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই সমন্বয়ের অভাব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি’ গঠন করা হয়েছিল গত বছর আগস্ট মাসে। ২৭ আগস্ট পর্যালোচনার তথ্য জনসম্মুখে উপস্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু করা হয়নি। ডেঙ্গু মহামারীতে আক্রান্ত দেশগুলো কীভাবে সমস্যা থেকে বের হয়ে এলো সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা এক সময় খুবই খারাপ ছিল। সেখানে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল ত্রিস্তরীয়। ফগার মেশিন দিয়ে ফগিং না করে মশার প্রজনন কেন্দ্র ধ্বংস করা হয় সেখানে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গবেষণাগার। ভিয়েতনামে চালু করা হয়েছে ই-ডেঙ্গু সফটওয়্যার। এটি মুঠোফোনে অ্যাপ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। সিঙ্গাপুর জোর দিয়েছে নির্মাণকাজে তদারকি। ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সি (এনইএ) এডিস মশা নির্মূলের জন্য ‘গ্র্যাভিট্র্যাপ’ নামের একটি বিশেষ ব্যবস্থা চালু করেছে। এটি বিশেষভাবে তৈরি একটি কালো রঙের পাত্র যা মশাকে আকর্ষণ করে। পাত্রটিতে এলেই মশা মারা যায়। ২০২০ সালের একটি হিসাব অনুযায়ী দেশটিতে সব মিলিয়ে ৬৮ হাজারের মতো ‘গ্র্যাভিট্র্যাপ’ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়া ‘ওলবাকিয়া’ নামে এক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছে। ‘ওলবাকিয়া’ ব্যাকটেরিয়াযুক্ত মশার প্রযুক্তি ব্যবহারের পর বিশ্ব মশা কর্মসূচি ডব্লিউ এমপি জানিয়েছে, বালি দ্বীপ এখন সম্পূর্ণ ডেঙ্গুমুক্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। ব্রাজিল ডেঙ্গু আক্রান্তের দিক থেকে শীর্ষ দেশ। তারা ‘সিনান’ নামের তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে সফলভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়েছে।
এসব পদক্ষেপের মধ্যে কোনটি আমাদের জন্য প্রযোজ্য তা খুঁজে বের করতে হবে। যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য সমন্বিত কৌশলগত কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। ঢ়েমন স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে জনগণকে সম্পৃক্ত করে চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে এডিস মশার সম্ভাব্য সব প্রজনন স্থান ধ্বংস করতে হবে। কার্যকর কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য যেসব বোতলজাত স্প্রে, কীটনাশক পাওয়া যায় সেগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে এর সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু টিকার উন্নয়নে অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে প্রডাকশন লাইসেন্সের ক্ষেত্রে সুলভে টিকা পাওয়ার সুযোগ নেয়া যায়।