আপদকালীন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে

9

গ্যাস সংকট, জ্বালানি তেল সংকট, বিদ্যুৎ সংকট, ওয়াসার পানি সংকট তৈরি হলে দেশের জনগণকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। শিল্পকারখানার উৎপাদন ও দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। স¤প্রতি দেখাগেছে এলএনজি সরবরাহের পাইপলাইন মেরামতের পরও কাটছে না গ্যাস সংকট। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি এক্সিলারেটের এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হলেও বর্তমানে চাহিদা ও সরবরাহের মাঝে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। ফলে গ্যাসের সংকট সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
যদিও পেট্রোবাংলা বলছে, সামিটের ক্ষতিগ্রস্ত এলএনজি টার্মিনালটি সিঙ্গাপুরে মেরামতের পর মহেশখালীতে এসে পৌঁছেছে। তবে এই টার্মিনাল থেকে গ্যাস পেতে আরও প্রায় ১৫ দিনের মতো সময় লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তখন সংকট কেটে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক এবং আবাসিকে স্বাভাবিক গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। সবখানেই গ্যাস সংকট বেড়ে চলেছে। সংশ্লিষ্টদের হিসাব বলছে, দেশে এখন প্রতিদিন ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ২৪৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ফলে প্রতিদিন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫০৪ মিলিয়ন ঘনফুট। এ তথ্য পেট্রোবাংলার।
সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিশাল এই ঘাটতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দেশের সবগুলো গ্যাস কোম্পানির উৎপাদন গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমে চলেছে। এর বিপরীতে কেবলমাত্র এলএনজি আমদানি করে চাহিদা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করে একাধিক দায়িত্বশীল বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস নিয়ে দুটো বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছে সরকার। প্রথমত, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় রেমালে মহেশখালীতে অবস্থিত বেসরকারি সামিট কোম্পানির ভাসমান এলএনজি টার্মিনালটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ও বিকল হয়ে যায়। সেটিকে মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। অপরদিকে ডলার এবং আর্থিক সংকটের কারণে ঠিক মতো এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে দেশে গ্যাস সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
দেশের খনিগুলো থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের হিসাব থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির উত্তোলন ক্ষমতা রয়েছে ৮১৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে উত্তোলন করা হচ্ছে ৫৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির ১৪৯ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতার মধ্যে ১১৬ মিলিয়ন ঘনফুট, আর বাপেক্সের ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যে ১১৬ মিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন করা যাচ্ছে।
বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে শেভরনের ১৫১২ মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে উত্তোলন করা হচ্ছে ১১৭০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং তাল্লোর ১০৩ মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যে ৩৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় গ্যাস কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খুব একটা বাড়েনি আবার কমেওনি। কিন্তু শেভরনের উৎপাদন অনেকটা কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে পেট্রোবাংলা। এরমধ্যে শেভরনের উৎপাদন ১৫১৫ থেকে ৩৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট কমে ১১৭০ মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে। এর বেশিরভাগই কমেছে দেশের সবচেয়ে বেশি গ্যাস উৎপাদনশীল ক্ষেত্র বিবিয়ানায়। এই খনিটি প্রতিদিন ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতো, এখন যা কমে ৯৯৭ মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে। একসঙ্গে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন কমে যাওয়ায় অন্য গ্যাস ফিল্ড থেকে এই পরিমাণ উৎপাদন বাড়ানো যায়নি।
সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, প্রতিদিন এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে ৮০০ থেকে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার কথা থাকলেও বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সামিট এলএনজির টার্মিনালটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দৈনিক ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট কম সরবরাহ হচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে পেট্রোবাংলা জানিয়েছিল।
বিদ্যুৎ জ্বালানি খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, চলমান গ্যাস সংকট কাটবে চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আগামী ১৫ বা ১৬ জুলাই সামিটের টার্মিনালটি দেশে আসবে। এরপর গ্যাস সরবরাহ শুরু করলে সংকট কেটে যাবে’।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে দৈনিক ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করা হয় ৯৭০ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে গ্যাসচালিত বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রর উৎপাদন সীমিত করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্যাস সংকটের খবর পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি কিছু এলাকায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিংও করা হচ্ছে। শহরাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের প্রভাব তেমন একটা না পড়লেও দেশের গ্রামাঞ্চলে তীব্র বিদ্যুৎ বিভ্রাটের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রাজধানীতে সিএনজি স্টেশনের বাইরেও লম্বা লাইন দেখা যায়। শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আবার গৃহস্থালি কাজে গ্যাসের চাপ কম থাকায় বিপাকে পড়েছেন গৃহিনীরা। ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় সকাল ৯ টার পর গ্যাস থাকছে না। আসছে বিকালে বা রাতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘এলএনজি সরবরাহের আনোয়ারা-ফৌজদারহাট পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। শুক্রবার মেরামতের পর কমিশনিং করা হয়েছে।
এদিকে সামিটের এলএনজি টার্মিনালও মেরামতের পর এখন মহেশখালীতে এসেছে। গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা আগে দিচ্ছিলাম ৩১০০ মিলিয়ন ঘনফুট, এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল চালু হলে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাবো। তখন গ্যাসের ঘাটতি কমে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসার পানি সংকট জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। দেশের অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধির সাথে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সম্পর্ক অস্বিকার করার কোন সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট সরকারি ও সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা এমন জরুরি জন-গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে আপদকালীন কোন ব্যবস্থা রাখতে দেখা যায় না। সংকট তৈরি হবার পূর্বে সংকট মোকাবেলার সুব্যবস্থা থাকা জরুরি। আমরা দেখি সংকট তৈরি হলে সংশ্লিষ্টরা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে থাকেন। তাতে জনগণের দুর্ভোগ কমে না। শুধু সংকট সমাধানের আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দিতে সক্ষম না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম ব্যর্থতারই পরিচায়ক। সংকটে আশ্বাস নয়, আপদকালীন ব্যবস্থা জোরদার করা গ্যাস কর্তৃপক্ষসহ সকল কর্তৃপক্ষের উচিত বলে মনে করে দেশের জনগণ।