আনোয়ারার কুনসুমা, হার না মানা নারী

3

ডেইজী মউদুদ

তিনি তাঁর নাম বলেছেন কুনসুমা। আসলে নামটির শুদ্ধতায় লিখলে হকে কুলসুমা। গ্রামে খাটি চাটগাঁইয়া ভাষায় কুলসুমকে ডাকেন কুনসু বলেই। ফলে তিনি তাঁর নামটি ও সেভাবেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বলছিলাম আনোয়ারার অপরাজিতা নারী কুনসুমার কথা। যিনি রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতায়িত হয়ে এলাকায় নানাবিধ কর্মকাÐে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
কুনসুমার বাড়ি আনোয়ারা উপজেলা বৈরাগ ইউনিয়নে তাঁর পিতার নাম ফজলে করিম (প্রয়াত), মায়ের নাম মোস্তফা খাতুন। কুনসুমা এলাকার দেওতলা সরকারি প্রাথমিক স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে পড়ৈকোরা নয়নতারা হাই স্কুলে অষ্টম শেণি পর্যন্ত পড়েন। তাঁর মাওে শখ মেয়েকে মাদ্রাসায় পড়াবেন। ফলে কুনসুমা শাহী দরবার ইসলামী কমপ্লেক্স থেকে ২০০৬ সালে দাখিল পাশ করেন। এরপর তিনি আনোয়ারা ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্ত্র এসময় তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। ফলে সেদিন থেকেই তাঁর একাডেমিক শিক্ষার যবনিকাপাত ঘটে। তবে স্বামী আবদুল আজিজের অনুপ্রেরণায় ২০০৭ সালে কুনসুমা রাজনীতির সাথে যুক্ত হন।পিতা ও শ্বশুর পরিবার আওয়ামী ভাবাদর্শের থাকায় কুনসুমা তৎকালীন মন্ত্রী আকতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর অনুপ্রেরণায় তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হবার সুযোগ পান।
পড়ৈকোরায় পিত্রালয় হলেও শ্বশুরবাড়ি বৈরাগ ইউনিয়নে হওয়ায় কুনসুমা ২০১৬ সালে ১ নম্বর বৈরাগ ইউনিয়নের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়ে সরাসরি ভাবে রাজনীতিতে অভিষিক্ত হন। সদস্য নির্বাচিত হয়ে কুনসুমা ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডেই জনপ্রতিনিধিত্ব করেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সফলতার সাথেই। এরই মাঝে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে কোন পুরুষ মেম্বার না থাকায় কাজের পুরা চাপ কুনসুমার উপরে বর্তায়। কুনসুমার তিন ওয়ার্ডে বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ায় তাঁকে কখনো এল এ শাখায়, কখনো থানায়, কখনো বা সালিশ বিচার ছাড়াও বাকি সময় রাতদিন তাঁকে ইউনিয়ন পরিষদে সময় দিতে হয়েছিল। রাতদিন শুধু কাজ আর কাজে দিন কাটে কুনসুমার। এলাকায় সামাজিক কাজে অবদান রাখায় ২০১৯ সালে কুনসুমা বেগম রোকেয়া দিবসে উপজেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা অর্জন করেন। এই অসামান্য স্বীকৃতির পর কুনসুমা ২০১৯ সালেই পুনরায় নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় তা আর হয়ে উঠেনি। কুনসুমা বলেন, তখন আমি আমার মতো কাজ করে যাচ্ছিলাম। তবে ইউনিয়র পরিষদের বরাদ্দগুলো নিয়ে বেশি ঝামেলা হতো। বরাদ্দ নিয়ে সমন্বয়ের প্রসঙ্গ আসতো।
আমি সমন্বয় প্রস্তাবে রাজি ছিলাম না। কারণ সমন্বয় করলে গরিবদের ভাগে কিছুই থাকবেনা। কুনসুমা তখন তাঁর নিজের মতো করে কাজ করছিলেন। ফলে কিছু স্বার্থান্বেষী ও দুষ্টচক্র তাঁর পেছনে লাগলো। শুরু হলো ক্ষমতার শুদ্ধ ব্যবহার আর অপব্যবহারকারীদের যুদ্ধ। এই দুষ্টচক্র ২০২১ সালের ২১ আগস্ট কুনসুমার উপর হামলা চালায়। তিরি গুরুতর আহত হলেও সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। এরপর শুরু হয় তাঁর ছেলের উপর হামলা। একদিকে নিজে তখনো সুস্থ হননি, আবার ছেলেকে নিয়ে টানাটানি। নিজের চিকিৎসা আর ছেলের চিকিৎসার টানাপোড়েনে রীতিমতো হিমসিম খেয়ে যান কুনসুমা। তারপরে ও কুনসুমা দমে যাননি। নিজের প্রচেষ্টা, স্বামীর সহযোগিতা আর জনগণের ভালোবাসায় কুনসুমা চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্ত নানা কারণে তা আর হয়ে উঠলোনা। ১০১৯ সাল থেকে কুনসুমা অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হন। এই যুক্ততায় কুনসুমা অন্য একটি জগৎ খুঁজে পান যেখানে নারীদেও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঠিক দিক নির্দেশনার চর্চা হয়। কুনসুমা বলেন, নারীদের কে রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতায়িত হওয়া জুরুরি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী সমাজের উন্নয়নে নানাবিধ পথ পরিক্রমা তৈরি করেছেন। কিন্তু সেগুলোর সুফল সঠিক জায়গায় বাস্তবায়ন অবশ্যম্ভাবী।
নারীরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হলেই প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। উন্নত বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে বিশ্বদরবারে। কুনসুমা তাঁর দীর্ঘ সংগ্রাম ও সাফল্যে তাঁর স্বামীর প্রেরণা আর সহযোগিতার কথা বার বার বলেন। অনেক কৃতজ্ঞতা জানান। স্বামী মো. আবদুল আজিজ, ছেলে তানভীর আজিজ অপু, মেয়ে উম্মে হাবিবা তাসফিয়া, ছেলে মো. আয়ানকে নিয়ে কুনসুমার ছোট্ট সংসার। এই ক্ষমতায়িত অপরাজিতার স্বপ্নবড় হোক আকাশ ছোঁয়া, সেটিই কাম্য।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক