‘অবাস্তব’ কারিকুলাম সংস্কার নয়, বাতিল করার দাবি

18

আসাদুজ্জামান রিপন

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুনভাবে স্বপ্ন দেখছেন শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, জোর করে একটি অবাস্তব শিক্ষা কারিকুলাম চাপিয়ে দিতে জাতিকে ধ্বংসের আয়োজন করেছে বিগত সরকারের দায়িত্বশীলরা।
নতুন কারিকুলাম বাতিলের দাবি ওঠার পর গত শনিবার শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা জানান, নতুন কারিকুলাম বাতিল নয়, সংস্কার করা হবে। পুরোনো পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষাক্রম চলবে, এতে পরীক্ষাপদ্ধতি থাকবে। শিগগিরই এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করা হবে। এ ঘোষণার পর অভিভাবকরা আবারও তৎপর হয়ে উঠছেন। তারা বলছেন, অবাস্তব ও জাতি ধ্বংসের আয়োজনকারী এ কারিকুলাম পুরোটাই বাতিল করে বাস্তবমুখি-জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে।
শিক্ষকরা বলছেন, এ শিক্ষাক্রম কোনোভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য নয়। শিক্ষকদের সাথে কোনো আলোচনা না করে কারিকুলাম চালু করা হয়েছিল। উল্টো কিছু না বলতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) থেকে অলিখিত নির্দেশনা ছিল।
এছাড়া শিক্ষাবিদরা বলছেন, বর্তমান কারিকুলাম এদেশে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। সবার সাথে আলোচনা করে যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রর্বতন করতে পারলে ফেরাটা ফলপ্রসু হবে।
নগরীর খাস্তগীর স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মাসুদ খান মুন্না পূর্বদেশকে বলেন, দুইবছর পরীক্ষা উৎসবের নাম দিয়ে জাতির সাথে মশকরা চলেছে। দুইটা বছর শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। এটা প্রমাণিত যে, এ কারিকুলাম এদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে বাস্তাবায়নযোগ্য নয়। সামনের বার্ষিক পরীক্ষা পুরানো পদ্ধতি নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা দিয়েছে ফিরে যাবে। তবে এখনও কোন প্রজ্ঞাপন জারি করেনি। শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করছে, তাদের নিয়ে একটা কমিশন গঠনের মাধ্যমে সবার সাথে আলোচনা করে বাস্তবসম্মত শিক্ষাক্রম তৈরি করুক।
বাকলিয়া স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাসুম বলেন, সামনে আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা হবে। কিসের ভিত্তিতে পরীক্ষা হবে, কীভাবে পরীক্ষা নিবে, সে বিষয়েও স্যাররা সঠিক ধারণা দেননি। আংশিক পরীক্ষা হবে, আবার অ্যাপসের মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে না কি বাতিল হবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছি।
ফরজানা আক্তার নামে আরেক অভিভাবক বলেন, অবাস্তব কারিকুলামের কারণে আমাদের সন্তানরা বই পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ডিভাইসে আশক্ত হচ্ছে। মেধা যাচাইয়ের জন্য কোনও পরীক্ষা নেই, মূল্যায়ন পদ্ধতিও যথাযথ নয়। সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া বিগত সরকার এই শিক্ষাক্রম হঠাৎ করে চাপিয়ে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষা পদ্ধতি একেবারে বাতিল করা উচিত। এ পদ্ধতিতে যথাযোগ্য মূল্যায়ন করার উপায় ছিল না। যারা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে তারাও এ কারিকুলাম নিয়ে পরিষ্কার ছিল না। তবে, যত দ্রুত সম্ভব আগের পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে যুগোপযোগী কারিকুলাম তৈরি করা হোক।
তিনি আরও বলেন, এ শিক্ষাপদ্ধতি থাকলে একটা মূর্খ জাতি তৈরি হবে। ক্লাসে যে পড়াশোনা চলছিল, সেখানে চাপ ছিল না। বাসায় গিয়ে কি পড়বে সেটিও চাপ ছিল না। ডিভাইস ভিত্তিক পড়াশোনা চালু করতে গিয়ে জাতিকে ধ্বংস করা হচ্ছিল। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক শাখার নির্বাহী সচিব সাইফুল ইসলাম চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, সরকার শিক্ষাক্রমে সংস্কারের ঘোষণাকে শিক্ষকরা সাধুবাদ জানিয়েছে। সবার সাথে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কার করলে তা ফলপ্রসু হবে। শিক্ষার্থীদের সঠিক মূল্যায়ন হবে। বিগত সরকার যে নতুন কারিকুলাম চালু করেছিল, তা অস্পষ্ট। শিক্ষার্থীরা কি পড়বে নিজেরাও জানে না। এটা নিয়ে কথা বলারও সুযোগ ছিল না। পরীক্ষা পদ্ধতি ছিল না। যার ফলে মূল্যায়নটা ঠিক ভাবে হচ্ছে না।
গত ১০ আগস্ট এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড শিক্ষাক্রম নিয়ে এক প্রশিক্ষণ কর্মশালা স্থগিত করা হয়েছিল।
এনসিটিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১১ আগস্ট থেকে বগুড়ায় অনুষ্ঠিতব্য শিক্ষাক্রম সংক্রান্ত কর্মশালা স্থগিত করা হয়। এরপর গত ১৮ আগস্ট সচিবালয়ে শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন যতদূর পারি আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাব। এমনভাবে যাব যাতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় অস্বস্তি না হয়। এরপর শিক্ষাক্রম নিয়ে আবারও আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। অভিভাবকরা দাবি জানাচ্ছেন, অবিলম্বে বর্তমান শিক্ষাক্রম বাতিল করতে হবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হয়। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে এ প্রক্রিয়া চালুর কথা রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষকরা মূল্যায়ন করে। নবম শ্রেণিতে বিভাগ পছন্দের বদলে একাদশে গিয়ে বিভাগ পছন্দের পদ্ধতিসহ শিক্ষাক্রমে নানা সংস্কারে বিক্ষুব্ধ ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা।