অপরিকল্পিত নগরায়ন, বৃক্ষ কর্তন ও তীব্র দাবদাহ

6

মো. দিদারুল আলম

বাংলাদেশে তীব্র তাপদাহ, প্রচন্ড গরম ও উত্তপ্ত আবহাওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও চাহিদা মত বনায়ন না হওয়ায় দেশে তাপমাত্রা ৭৬ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনই প্রধানতম দায়ী। সেই সঙ্গে অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলাধার কমে যাওয়া, বনভূমি সংরক্ষণ না করা, যত্রতত্র গাছপালা কেটে ফেলা, নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে বাড়ি-ঘর নির্মাণ ইত্যাদি দায়ী। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য জনগণকে সচেতন হতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়ন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। বেদখল হওয়া জলাধার তথা নদ-নদী, ও খাল-বিল পুনরুদ্ধার করে তা সংরক্ষণ করতে হবে। সবুজ বনায়ন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। প্রতিটি বাড়িতে গাছ লাগাতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রবাহিত তাপদাহের যে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে, তা এদেশে নতুন নয়। ঐতিহাসিকভাবে ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। ঢাকার ক্ষেত্রে, স্বাধীনতার আগে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং পরবর্তী সময়ে ২০১৪ এবং ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২৪ সালে তা ৪৩ ডিগ্রিতে উন্নীত হয়েছে।
বাংলাদেশে বনজ সম্পদ ও বনভূমির অবক্ষয় ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে যা পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশে ভূখন্ডের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য। বাংলাদেশের বন বিভাগের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে বন আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাব মতে, বাংলাদেশে বার্ষিক ২ দশমিক ৬ শতাংশ হারে বন উজাড় হয়েছে যা বার্ষিক বৈশ্বিক গড় হারের প্রায় দ্বিগুণ। গত ১৭ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান নগরগুলো, বিশেষত ঢাকা শহর এর মধ্যেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। চলতি পথে অনেকের মুখেই শোনা যায়, তারা এ শহর ছেড়ে চলে যেতে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। কিন্তু নিজ এলাকায় কোনো কাজের সুযোগ না পেয়ে তারা ঢাকা শহরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। চট্টগ্রাম শহরের অবস্থাও নাজুক। বাংলাদেশের সব প্রধান নগরই কমবেশি অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত ও অব্যবস্থাপনার শিকার। নগর উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তারা স্বেচ্ছাচারভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে যেটিই সত্য হোক না কেন, পরিণামে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে ক্ষতির ভার বহন করতে হচ্ছে জনগণকে।
দেশের ইতিহাসে এত বৃহৎ এলাকাজুড়ে তাপমাত্রার রেকর্ড নাই! এখন ৪০-৪২ ডিগ্রি ঢাকার তাপমাত্রা। সৌদির চেয়েও ৩-৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেশি ঢাকার। তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে ঝিনাইদহের শত শত নলকূপে উঠছে না পানি। চলতি মে মাসের তাপমাত্রা হবে আরও ভয়ংকর, সর্বোচ্চ হতে পারে ৪৪ ডিগ্রি । বর্তমানে তাপ প্রবাহ বইছে ৫১ জেলায়। প্রকৃতির এই আগুনঝরা তীব্র তাপদাহ বাড়িয়ে দিয়েছে; দেশজুড়ে বৈধ-অবৈধ অপরিকল্পিত ইটের ভাটা, শহর ও নগর অঞ্চলে মিল কারখানা, শপিংমল, দোকান মার্কেট, হোটেল মোটেল, বাসা বাড়ি, সর্বক্ষেত্রে এসির ব্যবহার প্রচন্ডভাবে বেড়ে গিয়েছে। তারই সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরিকল্পিত বৈধ-অবৈধ ব্যাটারি সিএনজি ডিজেল, পেট্রোলচালিত গাড়ি, রিকশা, অটোরিক্সা, বিভিন্ন যানবাহন, যার প্রতিটি কর্মকান্ড তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে কার্যকারী প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি আমাদেও দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন রকমের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারের ফলেও প্রতিনিয়ত উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। দেশজুড়ে নদী নালা, খাল বিল, পুকুর ডোবা, ভরাটের যেন একটি মহৎসব চলছে! এসব কর্মকান্ডই আজকের এই অনাকাঙ্খিত তীব্র তাপ প্রবাহের জন্য দায়ী।
আমাদের দৈনিক কৃতকর্ম সংবরণ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা কষ্টসাধ্য এবং চ্যালেঞ্জিং হবে। শুধুমাত্র বৃক্ষরোপণ করেই এই সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন করা কঠিন হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটগুলো ফসলের উপকারী পোকামাকড়ের অস্বিত্বকেও এখন হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে কৃষিতে নির্বিচারে রাসায়নিক ও কীটনাশক প্রয়োগ। যার ফলে এই অযাচিত কীটনাশক ফসলের মাটিতে মিশে মাটির কার্বন নিঃস্ফোরণকে বাড়য়ে তুলছে; যার কারণে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। সতর্ক থাকুন, সারাদেশে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ সেই সাথে বইছে বাতাস। এই সময় অগ্নিঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাছাড়া বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারে সতর্ক থাকুন।
বাংলাদেশে অনেকগুলো গার্মেন্ট কোম্পানি ‘গ্রিন বিল্ডিং’ ধারণার ওপর ভিত্তি করে বিল্ডিং বানালেও সাধারণভাবে অফিস-আদালত বা বাড়ি নির্মাণে সাধারণ মানুষের মাঝে এর কোনোই আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এর একটি কারণ, শুরুতে খরচ বেশি হওয়া। অথচ দূরভবিষ্যতের কথা মাথায় নিয়ে এ ধরনের পরিবেশবান্ধব স্থাপনা নির্মাণ করলে পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে এটি পরিশেষে লাভজনক হবে নিশ্চিত। ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’-এর প্রভাব হতো কম। রাজউক, সিডিএ কিংবা বিএনবিসি নির্মাণ বিধিমালায়, এ নিত্যনতুন ধারনাগুলো সংযোজনের মাধ্যমে আমাদের নগর পরিবেশ অনেকাংশেই উন্নত করা সম্ভব ছিল।
তীব্র দাবদাহ থেকে বাঁচতে জলাশয় ও সবুজ পরিসর বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। অবশিষ্ট যা আছে, সেগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে এবং দূষণমুক্ত করতে হবে। নির্মিত ভবনগুলোয় ছাদবাগান করায় উদ্যোগী হওয়া জরুরি। পরিবেশবান্ধব স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের মাটিকে দূষণমুক্ত করে গাছপালা জন্মানোর উপযোগী করাও প্রয়োজন। মোটকথা, পরিবেশ দূষণ রোধে সবাই সচেষ্ট হলে জলবায়ুজনিত এ বিপর্যয় মোকাবেলা সম্ভব। তবে সবকিছুই করতে হবে সুপরিকল্পিতভাবে। নগরবিদ, পরিকল্পনাবিদ, স্বাস্থ্য ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততায় দেশকে বাসযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।
বায়ুমÐল থেকে ক্ষতিকর উপাদান শোষণ করতে প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো উচিত। ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক বনায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা যতবেশি গাছ লাগানো হবে ততবেশি কার্বন শোষিত হবে। সামনে গাছ লাগানোর মৌসুম আসছে, তাই এখনই প্রস্তুতি নিন, কে কয়টি গাছ লাগাবেন? গাছ লাগানোতে প্রতিযোগিতা শুরু করা উচিত। কে কয়টি গাছ লাগাতে পারে! তবেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি মরুভূমি হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। শুধু নিজে একটি বা দুটি গাছ লাগালেই হবে না, গাছ লাগানোর এই মানসিকতা ছড়িয়ে দিতে হবে সব জায়গায়, তৈরি করতে হবে জনসচেতনতা, উদ্বুদ্ধ করতে হবে তরুণ সমাজকে। আসুন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সবাই গাছ লাগাই এবং বৃক্ষ কর্তন বন্ধ করতে হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলেজ শিক্ষক