অপরাধে ‘বেপরোয়া’ পুলিশ

26

তুষার দেব

উন্নত বিশ্বের আদলে পুলিশ বাহিনীকে সেবামুখী সংস্থায় পরিণত করতে ‘বদলে যাওয়ার’ নানা পদক্ষেপের মধ্যেও কতিপয় সদস্যের অপরাধে জড়ানোর ঘটনা কলঙ্কের দাগ টেনে দিচ্ছে। বাহিনীর প্রবিধানমালা অনুযায়ী অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরও পুলিশ সদস্যদের মধ্যে বিপথগামী হওয়া বা অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা কমছে না। উল্টো অপরাধে তারা ‘বেপরোয়া’ হয়ে উঠছে। আইনের পোশাকধারীদের বেআইনি কর্মকান্ডে জড়ানোর ঘটনাগুলো বাহিনীর ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাহিনীর একটি অংশের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া পুলিশে প্রচলিত অপরাধপ্রবণতাকে ফের নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক ও তদারককারী কর্মকর্তাদের অনৈতিক প্রশ্রয়ের কারণেই পুলিশের অভ্যন্তরে অপরাধপ্রবণতা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধস্তনদের কাছ থেকে ‘তোলা’ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। এতে অধস্তনরা দিনে দিনে যে কোনও ধরনের অপরাধ সংঘটনে বেপরোয়া হয়ে উঠে। পুলিশের অভ্যন্তরে বেশিরভাগ অপরাধের ঘটনাই চাপা থাকে। যখন কোনও অপরাধের ঘটনা প্রকাশ পেয়ে যায়, তখন উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার দায় না নেয়ার পাশাপাশি অভিযুক্তদের এড়িয়ে চলেন। এমন সংস্কৃতিই বাহিনীর অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে চালু রয়েছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, এখন পুলিশ বাহিনীর ভেতরে-বাইরে অনেক পরিবর্তন আনার গল্প আমরা শুনতে পাই। পেশাগত মনোন্নয়নের পাশাপাশি ভাবনা-চিন্তার দিক থেকেও বদলে যাওয়ার কথা শুনি। বাস্তবে পুলিশ বাহিনীর খোল-নলচে পরিস্কার করতে হলে নিচের দিক থেকে শুরু করে কিছুই হবে না। বরং উপরের দিক থেকে ঠিক করে নিচের দিকে আসতে হবে। পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিকসহ যে কোনও ধরনের প্রভাবমুক্ত রাখা ও পেশাদারিত্বের চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মোখলেছুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, কারও ব্যক্তিগত স্খলনের দায় কোনোভাবেই বাহিনীর নয়। বাহিনীর সদস্য হয়ে যে অপরাধে জড়াচ্ছে, তাকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ পুলিশ বাহিনীতে এখন আর নেই। পুলিশে অপরাধের শাস্তি দৃশ্যমান।
পুলিশ সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত রবিবার নগরীতে প্রবাসীর স্বর্ণ ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সোর্সসহ পুলিশের এক উপপরিদর্শককে (এসআই) কে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। দুপুরে নগরীর আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া দু’জন হলেন, এসআই আমিনুল ইসলাম ও সোর্স মো. জাহেদ। এসআই আমিনুল ইসলাম সিএমপির খুলশী থানায় কর্মরত রয়েছেন। জানা গেছে, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১৭ ভরি স্বর্ণ নিয়ে যাচ্ছিলেন লোহাগাড়ার সৌদিপ্রবাসী আব্দুল মালেক। পথে নগরীর টাইগারপাস এলাকায় তাকে আটক করেন এসআই আমিনুল ইসলাম। এসময় তার সোর্স মো. জাহেদ উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ পরিচয়ে তাকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তুলে নেন তারা। এরপর নগরীর বিভিন্ন সড়কে ঘুরিয়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এসময় তার কাছ থেকে ১৭ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেন তারা। খবর পেয়ে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ এসে এসআই আমিনুল ইসলাম ও সোর্স মো. জাহেদকে আটক করে।
এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নগরীর অক্সিজেনের গুলবাগ আবাসিক এলাকার চায়ের দোকান থেকে তুলে নেয়ার পর এক ফ্রিল্যান্সারের নগদ দশ লাখ টাকা ও তিন কোটি টাকা মূল্যের বিটকয়েন লুটে নেয়ার অভিযোগে গোয়েন্দা শাখার ছয় সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিএমপি। সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় তাদের বরখাস্ত করেন। তারা হলেন, উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আলমগীর হোসেন, এএসআই বাবুল মিয়া, শাহ পরান জান্নাত ও মইনুল হোসেন এবং কনস্টেবল জাহিদুর রহমান ও আবদুর রহমান। আর অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনার সময় ডিবি দলের নেতৃত্বে থাকা ইন্সপেক্টর রুহুল আমিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনার ভুক্তভোগী আবু বক্কর সিদ্দিক সরকারি নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার। নগরীর অক্সিজেন এলাকায় তার বাসা। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে গুলবাগ আবাসিক এলাকা থেকে তাকে ও বন্ধু ফয়জুল আমিনকে তুলে নিয়ে যায় ডিবির (উত্তর-দক্ষিণ) পরিদর্শক মো. রুহুল আমিনের নেতৃত্বে একটি দল। সেখান থেকে তাদের নগরীর মনছুরাবাদ গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরদিন ২৭ ফেব্রæয়ারি সকালে অনলাইনে জুয়া খেলার অভিযোগে আবু বক্কর ও ফয়জুলকে নন-এফআইআর প্রসিকিউশনের মাধ্যমে আদালতে হাজির করা হয়। জরিমানা দিয়ে মুক্তি পাওয়ার পর গত ২৯ ফেব্রুয়ারি আবু বক্কর অভিযোগ করেন, তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে আঙুলের ছাপ নিয়ে অনলাইন অ্যাপসের মাধ্যমে ডিবি পুলিশের সদস্যরা কোটি টাকার বিট কয়েন সরিয়ে নিয়েছে অন্য কোনও একাউন্টে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তড়িঘড়ি করে ঘটনার পাঁচ দিন পর গত ২ মার্চ আবু বক্কর ও গোয়েন্দা পুলিশের দুই সোর্সসহ তিনজনকে আসামি করে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানায় ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের অভিযোগে মামলা করে ডিবি। বায়েজিদ থানায় ডিবির এসআই মো. আলমগীর হোসেনের করা ওই মামলায় আবু বক্কর ছাড়াও পুলিশের সোর্স মো. কাউসার আহম্মদ (৩৫) ও শাহাদাত হোসেনকে (৩৫) আসামি করা হয়। ফ্রিল্যান্সার আবু বক্করকে পলাতক দেখিয়ে এবং সোর্স কাউসারকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান করে ডিবি। আবু বক্কর সিদ্দিককে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গত ৫ মার্চ আট পুলিশ সদস্যসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন আবু বক্করের স্ত্রী হুসনুম মামুরাত লুবাবা। আদালতের নির্দেশে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে।
উল্লেখ্য, পিআরবি-১৮৬১ (পুলিশ প্রবিধান) অনুযায়ী, কোনও পুলিশ সদস্য বাহিনীর শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও নৈতিকতাবিরোধী অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু ও গুরু) বিধান আছে। গুরুদন্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, অব্যাহতি, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত, বেতন বৃদ্ধি স্থগিত ও বিভাগীয় মামলা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে চাকরিচ্যুত করা হয়। গুরুদন্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রয়েছে। আর ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইনস বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদন্ড দেয়ার বিধান রয়েছে।