‘অনিরাপদ’ হাজতখানা

9

তুষার দেব

সার্বক্ষণিক নজরদারির আওতায় থাকা সুরক্ষিত হাজতখানাও নিরাপদ হয়ে উঠতে পারছে না। ভোরের আলো না ফুটতেই সিএমপির চান্দগাঁও থানা হাজতে বন্দি মো. জুয়েল নামে এক আসামির গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার ঘটনার পর ‘অনিরাপদ’ থানা হাজতের বিষয়টি পুনরায় আলোচিত হচ্ছে। হাজতখানার ভেতরে এমন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর দায় নিয়েও বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। সিসি ক্যামেরায় আত্মহত্যার চিত্র ধরা পড়লেও হাজতখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতে কর্তব্যরত পুলিশের গাফিলতির কথাও বলছেন অনেকে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর) মো. জাহাঙ্গীর বলেন, থানা হাজতে আসামি জুয়েল যে আত্মহত্যা করেছে, সেটা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঘটনার সময় হাজতে জুয়েল ছাড়া আর কোনও আসামি ছিল না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশের সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। পুরো ঘটনায় কর্তব্যরত পুলিশের কোনোধরনের অবহেলা বা গাফিলতি ছিল কিনা সেটা তদন্ত কমিটির সদস্যরা খতিয়ে দেখবেন।
সচেতন নাগরিক কমিটি মহানগর শাখার সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, সুরক্ষিত থানা হাজতে কোনও বন্দির এভাবে মৃত্যুর ঘটনা অবশ্যই উদ্বেগজনক। গ্রেপ্তার হওয়া কোনও আসামি থানা হেফাজতে আত্মহত্যা করলে পুলিশ কখনই এর দায় এড়াতে পারে না। থানার অভ্যন্তরে সবকিছু সার্বক্ষণিক নজরদারির আওতায় থাকে। এ ধরনের ঘটনার যথাযথ তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
হাজতখানায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া আসামি জুয়েলের স্বজনরা বলছেন, এর আগে তিনি তাদের বাসায় অন্তত দুই দফায় আত্মহননের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তবে পুলিশের গাফিলতির কারণে জুয়েলের মৃত্যু হয়েছে দাবি তার বড়বোন সালমা আক্তারের। হাজতখানায় ভাইয়ের এভাবে মৃত্যু মানতে পারছেন না তারা। জুয়েলের বড়বোন সালমা আক্তারের ভাষ্য, জুয়েল ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতেন। একটি গ্যারেজের মালিক থেকে কিস্তিতে জুয়েলকে একটি ব্যাটারি রিকশা কিনে দেন তার মা। কয়েকদিন আগে তার কাছ থেকে সেই রিকশাটি ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। এরপর থেকে রিকশা মালিকের ক্রমাগত মানসিক চাপ সহ্য করতে পারেন নি তিনি। তিন দিন আগেও জুয়েল তাদের বাসার বাথরুমে পরনের বেল্ট ঝুলিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের কারণে পারেন নি।
পুলিশের দাবি, অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়নামূলে গত মঙ্গলবার জুয়েলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ম অনুযায়ী থানা হাজতে রাখা হয়। পরদিন প্রথম পালায় তাকে আদালতে প্রেরণ করার কথা ছিল। ওই রাতে থানা হাজতে আর কোনও বন্দি ছিল না। গতকাল বুধবার ভোরে নিজের পরনের শার্ট খুলে গলায় পেঁচিয়ে থানা হাজতের ভেন্টিলেটরের সঙ্গে ফাঁসিতে ঝুলে পড়েন আসামি জুয়েল। হাজতখানার সিসিটিভি ফুটেজে তার আত্মহননের দৃশ্য ধরা পড়ে।
জুয়েলের বড় বোন সালমা আক্তারের জিজ্ঞাসা, থানা হাজতে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। সেখানে সারাক্ষণ পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। তাহলে হেফাজতে থাকা একজন আসামির জীবন কেন তারা রক্ষা করতে পারলেন না? থানা পুলিশ তার ভাইয়ের মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না। পুলিশের গাফলতিতেই তার ভাইয়ের এমন করুণ মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, কিস্তির টাকার দুচিন্তা থেকে বাঁচাতে তার ভাইয়ের স্ত্রীর কিছু অলঙ্কার বন্ধক রেখে ৩০ হাজার টাকা রিকশার মালিককে দেওয়া হয়। তবুও তারা দেড়লাখ টাকা পরিশোধের জন্য তার ভাইকে চাপ দিতে থাকেন। গ্যারেজ মালিকের মারধরের কারণে জুয়েল অসুস্থ হয়ে পড়ে। ব্যথায় কাতর হয়ে জুয়েল কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন ওষুধ সেবন করে আসছিল। মালিকপক্ষের মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। তবে পুলিশ তাকে বাঁচাতে পারতো। তাদের গাফিলতি আছে।
সন্তানহারা জুয়েলের মা মিনারা বেগম বলেন, পুলিশ আমার ছেলেকে সুস্থ অবস্থায় বাসা থেকে নিয়ে এসেছে। সে হাসিমুখে পুলিশের সাথে থানায় এসেছে। থানায় কেন সে মারা যাবে? তাকে আমার কাছে ফেরত দেন। কিস্তি (ঋণ) নিয়ে তাকে একটি অটোরিকশা কিনে দিই। কিন্তু সেটি চুরি হয়ে যায়। এরপর থেকে দেড় লাখ টাকা দেওয়ার জন্য মালিকপক্ষ আমাদের চাপ দিতে থাকেন। ছেলেকেও মারধর করে তারা। সেই হতাশা থেকে আমার ছেলে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু হাজতখানার মতো নিরাপদ জায়গায় আমার ছেলের ফাঁসি নেওয়া থেকে পুলিশ বাঁচানোর চেষ্টা করেনি।