অতি লাভের চাপে ভাতের পাতে ‘নেই হচ্ছে’ ডিম

6

এম এ হোসাইন

প্রোটিনের সবচেয়ে ভালো উৎস ডিম। সবার সাধ্যের মধ্যে থাকা এই ‘সুপারফুড’ এখন বাদ পড়ছে অনেকের খাদ্য তালিকা থেকে। অস্বাভাবিকভাবে দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিম খাওয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষকে। গত কয়েকদিন ডিমের বাজারের অস্থিরতায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে অনেকে।
প্রতিবছর কোরবানির ঈদের পরেই বাড়ে ডিমের দাম। তবে চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ দাম বেড়ে ডজনপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকা। গতবছর এই সময়ে ১৫৫ টাকা বিক্রি হয়েছিল। ২০২২ সালে কোরবানির ঈদের পরে ডজন ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব চট্টগ্রামের বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘একটা ডিমের দাম কিভাবে ১৫ টাকা হয়? কোরবানির ঈদের পরে ডিমের দাম বাড়ানো রীতিতে পরিণত হয়েছে। দাম বেড়ে প্রোটিন সমৃদ্ধ এই সুপারফুডটি এখন গরিবের খাদ্য তালিকা থেকে হারিয়ে যাওয়ার উপকৃম হয়েছে।’
সামর্থ্য না থাকায় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ মাছ-মাংস কিনতে পারছেন না। প্রোটিনের চাহিদা যোগান দিতে এসব মানুষরাই ডিম বেশি খান। পুষ্টির জন্য ডিমের ওপর নির্ভরশীল এসব মানুষ এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ঈদের পরেই ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। গত দু-সপ্তাহ ধরে সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে অতি প্রয়োজনীয় এই ভোগ্যপণ্যের দাম লাগামহীন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে কয়েক স্তরে গোটা দেশের ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিম ১৬০/১৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা কয়েক দিন আগেও ছিল ১৫০ টাকা। কিছুদিন আগেও একটি ডিমের দাম ছিল ১২ টাকা; এখন তা ক্রয় করতে লাগছে ১৪-১৫ টাকা।
কাজির দেউড়ি এলাকার বাসিন্দা ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ‘দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি ডিমে ৩ টাকা করে বেড়েছে। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে আমরা খাবো কি? এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, বাচ্চাকে দিনে একটি ডিম খাওয়ানোর পরিস্থিতিও হরিয়ে ফেলছি।’
ডিমের বাজারে অস্থিরতায় অতিরিক্ত লাভের প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। নগরের পাহাড়তলী এলাকায় ডিমের পাইকারি বাজারে অভিযান চালিয়ে অতি লাভে ডিম বিক্রির প্রমাণ পাওয়ায় দুই পাইকারি বিক্রেতাকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
অভিযান সম্পর্কে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ জানান, ‘অভিযানে পাহাড়তলীর ডিটি রোডে জান্নাত পোল্ট্রি নামে এক ডিমের ডিলারের দোকানে অতিরিক্ত লাভে পাইকারি ডিম বিক্রি করার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রতি ডিমে তারা লাভ করছে এক টাকা করে। আবার প্রদর্শিত মূল্য তালিকার চেয়েও ডিম বিক্রি করা হচ্ছিল বেশি দামে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজারে পাইকারি ও খুচরা ডিম বিক্রয়কারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই বাজারের আনিকা ইন্টারপ্রাইজ নামে পাইকারি ও খুচরা ডিমের দোকানিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।’
শুধু চট্টগ্রামে নয়, সারা দেশেই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে ডিম। ডিমের করপোরেট ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সক্রিয় চক্র বাজারে এমন অস্থিরতা তৈরি করছে বলে অভিযোগ আছে। ধাপে ধাপে বাড়তি লাভে বাড়ছে ডিমের দাম। ঢাকায় বসে পুরো দেশের ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে চক্রটি।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, ‘ডিম ব্যবসায়ী সমিতি এবং করপোরেট কোম্পানিগুলোর কারসাজিতে হুটহাট বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে নিঃস্ব হচ্ছেন প্রান্তিক খামারিরা। ক্ষুদ্র খামারিরা যখন ডিম উৎপাদন করেন তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক চক্র দাম কমিয়ে রাখে। এ অবস্থায় প্রান্তিক খামারিরা উৎপাদনে টিকে থাকতে পারেন না। তখন ক্ষুদ্র খামারিরা উৎপাদন কমিয়ে দিলে এ অসাধু চক্র ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত ১০ অর্থবছরে ডিম ও দুধ উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এ সময়ে মাংস উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ১৭ কোটি, যা এখন বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৮ কোটি। তবে বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে উৎপাদন বাড়ার সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ ভোক্তারা।