নিজস্ব প্রতিবেদক
পানি উন্নয়ন বোর্ড দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অধীনে ১১টি প্রকল্প চলমান আছে। চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারে এসব প্রকল্পে সাত হাজার ৮২৯ কোটি টাকার কাজ হচ্ছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে সর্বশেষ বছরখানেক আগে অনুমোদন হওয়া দুটির কাজ এখনো শুরু হয়নি। বাকি ৯টি প্রকল্প শেষ করতে গিয়ে ধুঁকছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সাত থেকে আট বছরেও শেষ হয়নি পাঁচটি প্রকল্পের কাজ। দ্রæত সময়ে কাজ শেষ করার চেয়ে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, মেয়াদ বৃদ্ধি ও প্রকল্প সংশোধনেই পাউবোর মনোযোগ বেশি। প্রায় প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় কিংবা মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবুও যথাসময়ে কাজ শেষ হয়নি। আগামী এক বছরের মধ্যে সাতটি প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি শেষ হওয়া কয়েকটি প্রকল্পের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী স্বপন কুমার বড়–য়া পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি যোগদান করার পর দ্রুত যাতে সবগুলো প্রকল্প শেষ হয় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের তাগাদা দিয়েছি। নির্ধারিত সময়ে অবশ্যই কাজ শেষ করতে হবে। কাজ শেষ করতে না পারলে ঠিকাদাররাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
পাউবো সূত্র জানায়, মিরসরাই উপজেলায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) বন্যা নিয়ন্ত্রণ সড়ক কাম বেড়িবাঁধ প্রতিরক্ষা ও নিষ্কাশন প্রকল্পটি ২০১৬ সালে অনুমোদিত হয়। এক হাজার ৬৩৯ কোটি টাকার প্রকল্পটি চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হবে। এ প্রকল্পের মেয়াদ বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে।
স›দ্বীপ উপজেলার পোল্ডার নং-৭২ এর ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের স্থায়ী পুনর্বাসনসহ ঢাল সংরক্ষণ প্রকল্পটি অনুমোদিত হয় ২০২৩ সালে। প্রকল্পটি এখন পাউবোর গলার কাঁটা। এই প্রকল্পে কাজ পাওয়া অধিকাংশ ঠিকাদার আওয়ামী লীগপন্থী হওয়ায় সরকার পতনের পর ঠিকাদাররা গাঁ ঢাকা দিয়েছে। ৫৬২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রকল্পটি ২০২৭ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়া নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। এখনো প্রকল্পের পাঁচ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।
খাগড়াছড়ি শহর ও তৎসংলগ্ন অবকাঠামো নদী ভাঙন হতে সংরক্ষণ প্রকল্পটি ২০২২ সালে অনুমোদিত হয়। চলতি মাসের জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো প্রকল্পের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ। ডিপিপির অর্ধেক টাকা ইতোমধ্যে ব্যয় হলেও এখনো কাজ শেষ হয়নি। এ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্প এলাকায় প্রকৌশলীরা না থাকায় ও ঠিকাদারদের গাফিলতির কারণে যথাসময়ে প্রকল্পটি শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলার সাঙ্গু এবং ডলু নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পটি ২০১৭ সালে শুরু হয়। এ পর্যন্ত দুইবার প্রকল্প সংশোধন হয়েছে। নতুন সংযুক্ত করা হয়েছে আটটি প্যাকেজ। চলতি বছরের জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো প্রায় ১০ শতাংশ কাজ বাকি আছে। আট বছর ধরেই এ প্রকল্প নিয়ে ধুঁকছে পাউবো। চট্টগ্রাম মহানগরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলামগ্নতা, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০১৮ সালে অনুমোদিত হয়। এই প্রকল্পটি ২০২৪ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বন্দরে জায়গা সংক্রান্ত জটিলতায় এটি যথাসময়ে শুরু হয়নি। পরে প্রকল্পটি সংশোধন করে পুনরায় কাজ শুরু হয়। এক হাজার ৬২ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি শেষ হতে আরও সময়ক্ষেপন হতে পারে।
পটিয়া উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালে। ২০২৪ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে আরও এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এক হাজার ১৫৮ কোটি টাকার প্রকল্পটির অগ্রগতি প্রায় ৪০ শতাংশ। একইভাবে পটিয়ায় ১৩৩ কোটি টাকায় শ্রীমাই খালে মাল্টিপারপাস হাইড্রোলিক এলিভেটেডে ড্যাম নির্মাণ হচ্ছে। এই প্রকল্পটিও আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালী উপজেলা এবং রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী ও ইছামতি নদী এবং শিলক খালসহ অন্যান্য খালের উভয় তীরের ভাঙন হতে রক্ষা প্রকল্পটি ২০১৮ সালে শুরু হয়। ২০২৪ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে এটি চলতি সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
কক্সবাজার জেলার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত নিরাপত্তা উন্নত করার জন্য উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় নাফ নদী বরাবর পোল্ডারসমূহ পুনর্বাসন প্রকল্পটি ২০১৭ সালে শুরু হয়। প্রকল্পটি চলতি সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো অর্ধেক কাজ বাকি আছে। প্রকল্পের নির্মাণ কাজের অনুসারে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব প্রকল্পে যেসব ঠিকাদার কাজ পেয়েছিল তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী। দলীয় বিবেচনায় পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশে তাদেরকে কাজ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এসব দলীয় ঠিকাদারদের বাড়তি সুবিধা দিতেই পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যয়, মেয়াদ ও প্রকল্প সংশোধন করতো। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ঠিকাদারদের অধিকাংশই গাঁ ঢাকা দিয়েছেন। যে কারণে কাজের গতি কমে যায়।
খাগড়াছড়ি মেরুং এলাকার বাসিন্দা নীতেশ চাকমা বলেন, ‘প্রকল্পের অধীনে নদী খননের কথা বলা হলেও সেগুলো তেমন কার্যকর হয়নি। পানি কমে গেলে মরা নদী থাকে। প্রকল্পের নিয়মিত কাজ চলে না। প্রকৌশলীরা মাঝেমধ্যে আসে বাকি সময় দেখা যায় না। শুনেছি এসব প্রকৌশলীরা বেশিরভাগ সময় চট্টগ্রামেই থাকে।’