পূর্বদেশ ডেস্ক
পাঁচটি দেওয়ানি ও চারটি ফৌজদারি- মোট ৯টি আইনের বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাধ্যতামূলকভাবে মধ্যস্থতার পথ বেছে নিয়েছে সরকার। এসব আইনের আওতায় কোনো বিরোধে সরাসরি মামলা করা যাবে না; প্রথমে লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে মধ্যস্থতার চেষ্টা করতে হবে। কেবল মধ্যস্থতা ব্যর্থ হলেই আদালতে মামলা দায়েরের সুযোগ থাকবে।
আইন মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এর উদ্দেশ্য হলো- ভুয়া মামলা কমানো, নির্দোষ ব্যক্তিকে মামলায় জড়ানো রোধ করা, মামলার চাপ হ্রাস এবং বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি কমানো। এই উদ্দেশ্যে ২০০০ সালের ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন’-এর সংশোধনের মাধ্যমে ‘অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ’ নামে একটি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে, যা ১ জুলাই আইন ও বিচার বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
তবে আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন, এতে বিচারপ্রার্থী হয়রানির শিকার হবেন এবং বিচারপ্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা আরও বাড়বে।
জানা গেছে, দেশের আইন অঙ্গনে বছরের পর বছর মামলার চাপ বাড়ছে। মামলার চাপ কমানো, নির্দোষ ব্যক্তিদের হয়রানি থেকে মুক্তি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘবের কথা বলেই এই ৯টি আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারিকৃত এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০০০ সালের ৬ নম্বর ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন’-এ সংশোধন আনা হয়েছে। অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ নামে যে ৯টি আইনের ধারা লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো হলো- ‘পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩-এর ধারা ৫’; ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’; ‘সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত বণ্টন সম্পর্কিত বিরোধ’; ‘স্টেট অ্যাকুজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০-এর সেকশন ৯৬-এ উল্লিখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ’; ‘নন-এগ্রিকালচারাল টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৪৯-এর সেকশন ২৪-এ উল্লিখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ’ এবং ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩-এর ধারা ৮ অনুসারে পিতা-মাতার ভরণপোষণ সম্পর্কিত বিরোধ’।
এছাড়াও ‘নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট, ১৮৮১-এর সেকশন ১৩৮-এ বর্ণিত চেক ডিসঅনার সম্পর্কিত অভিযোগ (অনধিক ৫ লাখ টাকা মূল্যমান চেকের ক্ষেত্রে)’; ‘যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ধারা ৩ ও ৪-এ বর্ণিত যৌতুক সম্পর্কিত অভিযোগ’ এবং ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ধারা ১১(গ)-তে বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতন সম্পর্কিত অভিযোগ’-এর ক্ষেত্রেই নতুন এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।
এসব আইন পরিবর্তনের পর আইনজীবীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘এটার কার্যকারিতা শুরু হলে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি হবে। লিগ্যাল এইডের দীর্ঘসূত্রতায় অনেকে আগ্রহ হারাবে। মধ্যস্থতার কথা বলে সময়ের পর সময় নিতে থাকবে অপরপক্ষ। তদন্তের নামে হয়রানি আরও বাড়বে’।
দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি লিগ্যাল এইড অফিসার থাকেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি জেলায় একজন কর্মকর্তা দিয়ে এত কাজ করা অনেক কঠিন হবে। ঢাকা জজ কোর্টে ৩৭টি সিএমএম আদালতে বিচারক এ সংক্রান্ত মামলা শেষ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর একজন লিগ্যাল অফিসারকে দিয়ে কীভাবে এত কাজ করা সম্ভব হবে?’
ঢাকা মহানগরের আইনজীবী রুহুল আমিন বলেন, ‘একজন নারীকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করার পর সে কীভাবে মধ্যস্থতা করতে যাবে? নারীরা সমাজ ও পরিবারে এমনিতেই দুর্বল পক্ষ। এখন এ আইনে তাদের আরও দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কোনো আইডিয়া আছে? মেয়েদের জন্য বাস্তবতা কতো কঠিন হচ্ছে? এটা তো আইনেরও পরিপন্থি কাজ। একজন মানুষ আগে যেখানে অন্যায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনের কাছে আশ্রয় নিতে পারতো, এখন তাকে লিগ্যাল এইডে মধ্যস্থতার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। এছাড়া প্রতিদিন কী পরিমাণ ১৩৮ ধারার চেকের মামলা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলা এবং মহানগর আদালতগুলোতে দায়ের হয়? ঢাকার প্রায় ৪৫ জন ম্যাজিস্ট্রেট যেখানে প্রতিদিন মামলা গ্রহণ ও বিচার পূর্ববর্তী কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খায় সেখানে একজন বিচারকের নেতৃত্বাধীন লিগ্যাল এইড অফিস কীভাবে কী করবে? বুঝে আসে না। সঙ্গে আছে পারিবারিক মামলা, যৌতুক, নারী শিশু নির্যাতন ও দেওয়ানি মামলা। পাহাড় সমান চাপ সামলানোর সক্ষমতা লিগ্যাল এইড অফিসের আছে কী?’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘এই ধরনের বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা চালু করার আগে সিনিয়র আইনজীবী, বিচারপতি ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করাই ছিল সমীচীন। কারণ আইনের উদ্দেশ্য যদি হয় ন্যায়বিচার সহজতর করা, তাহলে যেকোনো প্রক্রিয়া বিচারপ্রাপ্তির পথকে দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল করলে তা মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি হয়ে দাঁড়ায়’।
কিছু ফৌজদারি অপরাধে মামলা দায়েরের আগে নতুন করে আরবিট্রেশনের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। যেসব মামলা এমনিতেই আপসযোগ্য বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এসব মামলায় রায়ের আগে আপসের মাধ্যমে প্রত্যাহারের সুযোগ আছে। তাই মামলা দায়েরের আগেই লিগ্যাল এইডে যাওয়ার বিধান করে অভিযুক্তকে শাস্তির ভয় থেকে দূরে রাখা হলো। এর মাধ্যমে অপরাধী সুযোগ পাবে ও বিচারপ্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা আরও বাড়বে। এই অধ্যাদেশের কারণে সাধারণ মানুষের হয়রানি এবং ক্ষতি আরও বাড়বে। সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য একটি অধ্যাদেশ’। অনতিবিলম্ব এই অধ্যাদেশ বাতিল করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।