৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সরকারি বিদ্যালয় : বশরত নগর স্কুল ও কিছু কথা

1

লিটন দাশ গুপ্ত

৮ম শ্রেণি পর্যন্ত এক স্কুলের নাম বশরত নগর স্কুল, যেটি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলাধীন পূর্ব কালুরঘাট সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। যেহেতু এই স্কুলে বা এই রকম স্কুলগুলোতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিখন শেখানো কার্যক্রম সম্পন্ন হয়, তাই এই ধরনের বিদ্যালয়গুলোকে প্রাথমিক স্কুল বলব, নাকি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল বলব বুঝে উঠতে পারছিনা। যদিও সাড়া দেশে প্রথম পর্যায়ে ৩৯১ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সম্প্রসারিত করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত রূপান্তর করা হয়েছে, সেই হিসাবে বিদ্যালয়গুলো দাপ্তরিকভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসাবে স্বীকৃত। তবে ১ম শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত বইয়ের মলাটে লেখা আছে প্রাথমিক এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ৮ম শ্রেণির প্রত্যেক বইয়ের প্রচ্ছদে লেখা আছে নিম্ন মাধ্যমিক (যদিও কয়েক বছর আগে থেকে নিম্ন মাধ্যমিক লেখা বাদ দেয়া হয়েছে)। এখানে শিক্ষার সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরাধীন। অর্থাৎ দুই মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত নীতিমালা ও নির্দেশনায় পরিচালিত হয় বিদ্যালয়গুলো। এইদিকে আবার প্রাথমিক শিক্ষায় ‘নেপ’ এর অধীন এবং মাধ্যমিক শাখায় শিক্ষাবোর্ডের অধীন অনেক কাজ রয়েছে। বলতে গেলে বশরত নগর স্কুলের মত এই জাতীয় সম্প্রসারিত স্কুলগুলোকে প্রাক-প্রাথমিক স্তর, প্রাথমিক স্তর, নিম্ন-মাধ্যমিক স্তর এই তিন স্তরের দশটি ক্লাস পরিচালনা করতে হয়।
২০১৩ সালে শুরু হওয়া এই বিদ্যালয়গুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রধানশিক্ষক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে বা আনা হয়েছে যাদের মাস্টার্স ডিগ্রীসহ বিএড, এমএড ডিগ্রী এবং দশ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে। একইসাথে এই রকম প্রত্যেক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ ৭ম ৮ম অতিরিক্ত ৩ ক্লাসের জন্য ৩ জন বা ততোধিক সহকারি শিক্ষক যাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়সহ বিএড/এমএড রয়েছে তাদেরকে প্রেষণে বদলী করা হয়েছে। শুরুর দিকে স্কুলগুলোতে জমজমাট আয়োজন, শিক্ষায় সফলতাসহ দীপ্তিময় এক সোনালী অধ্যায় ছিল। বলতে গেলে এখন আর সেই জৌলুস নেই! বশরত নগর স্কুলের কথা যদি বলি, একসময় এই বিদ্যালয়ে জেএসসি’তে টেলেন্টপুলসহ অনেক সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি ও শতভাগ পাশের রেকর্ড উপজেলা পর্যায়ে ঈর্ষণীয় ছিল। গগনচুম্বি সফলতায় অনেকে বিস্ময়ের সাথে মুগ্ধ হয়েছে। তাই নতুন বছর শুরুতে নি¤œমাধ্যমিকের প্রতি শ্রেণিতে তিন চারশ আবেদন থেকে একশ শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য বাছাই করে ভর্তি করানো মানে রীতিমত যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হত। এখন আর সেই দিন নাই। এরই মধ্যে চারটি ভবনের পরিচ্ছন্নতাসহ কাজের ব্যাপকতা দেখে দপ্তরি কাম প্রহরী চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়েছে।
নিম্নমাধ্যমিক হিসাবে অতিরিক্ত প্রেষণে নিয়োগ তিন শিক্ষক নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে গিয়েছে। ভৌত ও অভৌত অবকাঠামোর স্বল্পতার কারণে উপজেলা প্রশাসনের মৌখিক নির্দেশে শিক্ষার্থী ভর্তি ২৫ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে। এই চিত্র শুধু বশরত নগর স্কুলের নয়, আমার জানা শোনা পরিচিত প্রায় সকল স্কুলের চিত্র একই। এই সকল স্কুলে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় কোন বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষিত শিক্ষক নাই। নিম্নমাধ্যমিক তথা দশটি শ্রেণির অনেকগুলো শাখা পরিচালনার জন্য প্রধানশিক্ষকের সহযোগি হিসাবে একজন সহকারি প্রধানশিক্ষক নাই। শতাধিক রেজিস্টার হালফিল করে রাখার জন্য কোন অফিস সহকারী নাই। বিশাল স্কুল এলাকা শ্রেণিকক্ষ মাঠঘাট আশপাশ পরিষ্কার রাখার জন্য কোন পরিচ্ছন্ন কর্মী, মালী বা আয়া পদ নাই। দুই মন্ত্রণালয়ের অধীন ১২/১৪ টা সার্ভারে নিয়মিত কাজ করতে হয়, কিন্তু কোন কম্পিউটার অপারেটর নাই। চাহিদা অনুসারে নতুন ভবন বা শ্রেণিকক্ষ, আলাদা অফিসকক্ষ ও নিম্নমাধ্যমিক স্তরের অপেক্ষাকৃত বড় শিক্ষার্থীর উপযোগি বেঞ্চ, চেয়ার টেবিল বা আসবাবপত্র নাই। আইসিটি ল্যাব, লাইব্রেরি, বিজ্ঞানাগার, মিলনায়তন, প্রার্থনা কক্ষ, অডিটোরিয়াম বলতে কিছুই নাই। উপজেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটিতে প্রধানশিক্ষকের অন্তর্ভুক্তি নাই। অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ও শ্রেণির জন্য প্রয়োজনীয় কন্টিজেন্সি বরাদ্দ দেয়া নাই। একাধিক বার বই আনতে হয় কিন্তু কোন পরিবহন ভাতা নাই। ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির শিক্ষা উপকরণ ক্রয় ও অন্যান্য খরচের জন্য কোন প্রকার আলাদা বরাদ্দ প্রদান নাই। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থী বিভিন্ন জায়গায় আনা নেয়া ও আপ্যায়নের জন্য কোন টাকা পয়সা নাই। প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ছাড়াও মাধ্যমিক অফিস, অন্যান্য অফিস ও শিক্ষাবোর্ডে যাতায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্রমণ ভাতার বরাদ্দ প্রদান করা নাই। নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক হিসাবে কোন প্রকার উচ্চতর গ্রেড, বেতন স্কেল কিংবা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা নাই। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী অনুপাতে স্লিপ অনুদানে ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীর কোন বরাদ্দ নাই।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মত শিক্ষার্থী ভর্তি, সেশন ফি, মাসিক ফি, পরীক্ষার ফিসহ অন্যান্য কোন প্রকার ফি গ্রহনের নীতিমালা নাই। এই রকম আরো অনেক কিছু শুধু নাই আর নাই!
এখন কথা হচ্ছে, আমার নিবন্ধ এই পর্যন্ত পড়ে অনেকে বলতে পারেন, ‘নাই নাই নাই; তাহলে আপনার স্কুলে কি আছে?’ সেই হিসাবে আমি বলতে পারি, ‘আমার স্কুলে আমি আছি, আর স্বল্প সংখ্যক সহকারি শিক্ষক, বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এবং হাজারো সমস্যা আছে!’ এ ছাড়া বাস্তবে কি আর বলব, কিই বা বলার আছে? এককথায় বলতে গেলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল গুলোতে এমন এক অবস্থা যেন- সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা! আবারও বলছি এটি শুধু বশরত নগর স্কুল নয়, এটি সাড়া দেশে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত স্কুলগুলোর চিত্র। সীমাহীন সমস্যায় জর্জরিত এ ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। অনেকে আবার প্রশ্ন করতে পারেন, ‘এমন হলে আপনি বদলী না হয়ে এই স্কুলে আসলেন কেন বা আছেন কেন?’ অন্যরা কেন আছে সেটা আমি বলবনা, তবে আমি আমার কথা বলতে পারি- এখানে আসার কারণ হচ্ছে নিজের অর্জিত শিক্ষা ও আহরিত জ্ঞান দক্ষতা অভিজ্ঞতা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োগ করে শিক্ষায় সার্বিক পরিবর্তন আনার জন্য এবং ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত একটি সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক হিসাবে স্ব-ব্যক্তিত্ব প্রদর্শনের জন্য! অর্থাৎ নিম্নমাধ্যমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক হিসাবে উচ্চস্তরের বন্ধুবান্ধব তথা আত্মীয় স্বজনের সমকক্ষ বা তাদের সাথে সম্পৃক্ত হবার জন্য। স্ব-ব্যক্তিত্ব প্রদর্শন কথাটি ঋনাত্বক মনে হলেও ব্যক্তি বিশেষের জন্য প্রযোজ্য। তাই এখানে বলা বাহুল্য হলেও না বললে নয়, আমি ‘সিইনএড’ নিয়ে প্রাথমিকস্তরে যেমন শিক্ষকতা করেছি, আবার ‘এনটিআরসিএ’ থেকে প্রভাষক পদে নিবন্ধন নিয়ে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাও নিয়েছি। তাছাড়া প্রশিক্ষণার্থী হিসাবে দেশ-বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ যেমন নিয়েছি, আবার প্রশিক্ষক হিসাবে শিক্ষকদেরকেও প্রশিক্ষণ দিয়েছি। শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের আগে শিক্ষা বিষয়ক বিএড, এমএড ডিগ্রী সম্পন্ন করে এসেছি। ভিয়েতনাম থেকে ‘কেবিএল এন্ড কেবিটি’ প্রশিক্ষণ পেয়েছি। শুধু তা নয়, মাধ্যমিকে গণিত শিক্ষার্থীর অনগ্রসরতা নিয়ে যেমন থিসিস করেছি, আইন বিষয় নিয়েও লেখাপড়া করে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেছি। এমতাবস্থায় আমি এমন বিদ্যালয়ে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ও শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য আগমন বলা যেতে পারে। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বশরত নগর স্কুলে যোগদানের সময় অনেকে বিস্মিত হয়ে বলেছেন, ‘এমন ইয়ং ছেলে এতবড় স্কুলের প্রধান শিক্ষক! কিছু দিন আগে জনৈক ব্যক্তি কথার প্রসঙ্গে আমার থেকে জানতে চাইল, ‘আপনি কত সালে অবসরে গেছেন?’ তিনি আমাকে বয়স্ক মনে করেছেন। আসলে এই স্কুলে শিক্ষকতা করতে গিয়ে আয়নাতে নিজের মুখ দেখার সময় পায়নি, তাই কখন বৃদ্ধ হয়ে গেলাম বুঝতে পারিনি! লোকটির কথা শুনে আয়নায় নিজেকে দেখলাম, সত্যিই অনেক বুড়ো হয়ে গিয়েছি! যদিও বয়সের বছর সংখ্যায় এখনো হাফ সেঞ্চুরি করতে পারিনি।
যাই হোক পরিশেষে বলতে চাই- এই স্কুলগুলোতে উল্লেখিত সমস্যাগুলো ভবিষ্যতে আশু সমাধান হবার উপায় আছে কিনা জানিনা, কিংবা এইসব স্কুল ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত না-রাখা বা রাখা সমীচীন হবে কিনা এই বিষয়ে আমার বলারও কিছুই নাই। তবে এই অবস্থায় এটাই বলতে পারি- পরানের স্কুলরে, বুড়া হইলাম তোর কারণে…!
লেখক: প্রধান শিক্ষক- পশ্চিম গোমদন্ডী বশরত নগর সরকারি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পূর্ব কালুরঘাট, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।