আনোয়ারা প্রতিনিধি
আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় গত ৭ বছর ধরে মানুষের আতঙ্ক ছিল কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) এলাকায় অবস্থান করা হাতিগুলো। তাদের আক্রমণে এ পর্যন্ত প্রায় ২০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। অসংখ্য বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা, জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। গত এক বছরে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী থানায় হাতির তাÐবে ক্ষতির ঘটনায় থানায় জিডি করা হয়েছে শতাধিক।
হাতির আক্রমণে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির বেশিরভাগই হয়েছে কেইপিজেডের পাশ্ববর্তী আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়ন ও কর্ণফুলীর বড় উঠান ইউনিয়নে।
সম্প্রতি কর্ণফুলীর শাহমীরপুরে হাতির আক্রমণে ৭ মাসের একটি শিশু মারা গেলে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। স্থানীয়রা শুরু করেন আন্দোলন। কেইপিজেড থেকে হাতিগুলো সরিয়ে নিতে হয়েছে মিছিল-মিটিং ও সড়ক অবরোধ।গত রমজানে শবে কদরের দিন হাতি তাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে নামে দৌলতপুরসহ আশেপাশের হাজারো মানুষ। আন্দোলকারীরা দুই দফায় চট্টগ্রাম-আনোয়ারা-বাঁশখালী সড়ক অবরোধ করে। এরপর টনক নড়ে প্রশাসন ও বনবিভাগের। তাদের যৌথ সভায় সিদ্ধান্ত হয় হাতিগুলো কৌশলে সরিয়ে নেবে বনবিভাগ।
কয়েকদিন আগে খুশির সংবাদ দেয় বনবিভাগ। তান্ডব চালানো ৩ হাতির একটিও নেই কেইপিজেড এলাকায়। এতে স্বস্তি ফিরেছে স্থানীয়দের মাঝে।
এদিকে হাতিগুলো যাতে আবার লোকালয়ে ফিরতে না পারে, সেজন্য এ্যালিফেন্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) টিমের সদস্যরা মোতায়েন রয়েছেন বলে জানান বন বিভাগের বাঁশখালী জলদী রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ।
কেইপিজেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. মুশফিকুর রহমান জানান, হাতিগুলো দেখা যাচ্ছে না। বনবিভাগের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেন, হাতিগুলো এখন আর কেইপিজেড এলাকায় নেই।
এ বিষয়ে বাঁশখালী জলদী রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, দু’টি হাতি এমনিতেই চলে আসে। বাকি একটি আমাদের ইআরটি টিম কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন কৌশলে বাঁশখালী বনে নিয়ে গেছে। আবার হাতি ফিরে আসতে চাইলে কারও আটকানোর সাধ্য নেই। তবে হাতিগুলো যাতে ফিরতে না পারে, সেজন্য তৈলারদ্বীপ এলাকায় এআরটি টিমের সদস্যরা নিযুক্ত থাকবেন।
জানা গেছে, ঈদের পর থেকে হাতিগুলোর গতিবিধি নজরদারিতে রেখেছে বনবিভাগের লোকজন। হাতিগুলো যখন কেইপিজেডের বন থেকে বের হয়ে চায়না ইকোনমিক জোনের পাহাড়ে অবস্থান নেয়, তখন থেকে হাতিগুলোকে আর কেইপিজেডের দিকে ফিরে যেতে দেওয়া হয়নি। ইআরটি টিমের সদস্যরা হাতিগুলোকে এক প্রকার ঘেরাও করে চুনতি অভয়ারণ্যে চলে যেতে বাধ্য করে।
বনবিভাগের কর্মকর্তা মো. ফোরকান বলেন, প্রথমদিনে দুটি হাতি চলে গেলেও ইআরটি টিমের সদস্যদের ঘেরাও থেকে ফসকে একটি হাতি থেকে যায়। পরবর্তীতে সেই হাতিটিকেও কৌশলে অভয়ারণ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে ১০ জন ইআরটি সদস্য হাতিগুলো যাতে আর আনোয়ারায় ফিরতে না পারে তার জন্য পাহারায় রয়েছে। যদি হাতিগুলো আনোয়ারায় ঢুকতে চেষ্টা করে তখন আমাদের জানালে আমরা আনোয়ারার ৫০ জন ইআরটি সদস্য নিয়ে হাতিগুলো তাড়িয়ে দিতে কাজ করব।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রায় একযুগ আগে বন্যহাতির দল আনোয়ারার কেইপিজেড এলাকায় আসতে শুরু করে। গত ৭ বছর ধরে হাতিগুলো কেইপিজেড ও দেয়াংপাহাড়ের বটতলী এলাকায় বসবাস শুরু করে। পাহাড় থেকে হাতিগুলো কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠানের দৌলতপুর, দক্ষিণ শাহমীরপুর এবং আনোয়ারার গুয়াপঞ্চক, বৈরাগ, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল, বটতলী, হাজিগাঁও, গুচ্ছগ্রামে নেমে গত ৭ বছর ধরে প্রায় ২০ জনের প্রাণহানি ঘটিয়েছে।
বন বিভাগ ও স্থানীয়রা জানিয়েছে, হাতির আক্রমণে নিহত হন প্রায় ২০ জন। তাদের মধ্যে গত ২৩ সেপ্টেম্বর মো. দুলাল (৫০) ও রেহেনা আক্তারের (৩৫), ১২ সেপ্টেম্বর কর্ণফুলীর দৌলতপুরের মো. ছৈয়দ (৫৭) ও ২৫ জানুয়ারি আনোয়ারার বটতলী ইউনিয়নের বদরুদ্দীন (২৯), ২৩ সালের ৫ জুলাই আনোয়ারার হাজীগাঁওয়ের ছাবের আহমদ (৭৫), ২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আনোয়ারার বটতলীর আজিজ ফকির (৭০), ১০ অক্টোবর গুয়াপঞ্চকের এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি (৬০), কর্ণফুলীর খিলপাড়া গ্রামের জালাল আহমদ (৭২), ২০ সালের ৭ জানুয়ারি আনোয়ারার বটতলীর নুরপাড়ার মো. সোলায়মান (৭০), ২ ফেব্রুয়ারি উত্তর গুয়াপঞ্চকের দেবী রানী দে (৪৫), ২০ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলীর দক্ষিণ শাহমীরপুর গ্রামের মায়া রানী বড়ুয়া (৬০) ও ১৫ জুলাই আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়নের আখতার হোসেন চৌধুরী (৫০), ১৯ সালের ২৬ জুন আনোয়ারার বটতলীর গুচ্ছগ্রামের মোমেনা খাতুন (৬৫), ১৫ জুলাই বৈরাগ ইউনিয়নের আখতার হোসেন চৌধুরী (৫০), ১৮ আগস্ট বারখাইন ইউনিয়নের আবদুল মোতালেব (৬৮), ১৮ সালের ১৩ জুলাই বৈরাগ ইউনিয়নের আবদুর রহমান (৭০) নিহত হন।