নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা রুটটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ। সবচেয়ে বেশি ট্রেন যাত্রীও এই রুটে। যাত্রী সেবা বাড়াতে এবং যাতায়াত সময় কমিয়ে আনতে ৩২১ কিলোমিটার রেলপথ ডাবল লাইন করা হয়। এ রুটে আগে ২৪৯ কিলোমিটার ডাবল লাইন কাজ শেষ হলেও লাকসাম থেকে আখাউড়া রেল স্টেশন পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার গত বছরের জুলাই মাসে যুক্ত হয়। কিন্তু ডাবল লাইনের লাকসাম থেকে আখাউড়া রুটের এই ৭২ কিলোমিটার নিয়ে রেলের দুশ্চিন্তা বেশি। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় বিপদজনক রেলপথে পরিণত হয়েছে রুটটি। অবৈধ লেভেল ক্রসিং, লোকোমাস্টারের অসাবধানতা, রেললাইনে ক্রুটি, সিগন্যাল অমান্যের কারণেও প্রায় সময় সেখানে দুর্ঘটনা ঘটছে। এই ৭২ কিলোমিটার ‘মৃত্যুকূপে’ ৬১টি রেলক্রসিং আছে। এরমধ্যে ৩৮টিই অবৈধ।
সর্বশেষ গতকাল (মঙ্গলবার) কুমিল্লার বুড়িচংয়ের কালিকাপুর রেলক্রসিং এলাকায় দুর্ঘটনায় সাতজন মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। রেলওয়ের কাছ থেকে কোনরূপ অনুমতি না নিয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সড়ক নেয়ায় এই রেলক্রসিং নির্মিত হয়েছে। এই রেল ক্রসিং পার হতে গিয়েই সুবর্না এক্সপ্রেসের ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে যায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এ ঘটনায় সহকারী পরিবহন কর্মকর্তাকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটিতে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এবিএম কামরুজ্জামান পূর্বদেশকে বলেন, ‘বারবার দুর্ঘটনা হওয়ার প্রধান কারণ বিনা অনুমতির রেলগেট। রেলের কোনরূপ অনুমতি না নিয়ে করা এসব গেটে গেটম্যান থাকার কথাও না, থাকেও না। যেখানেই গেট করুক রেলের পারমিশন নিয়ে করতে হবে। এছাড়াও সরকারি দপ্তর কোন রাস্তাঘাট করতে গেলে ওভারপাস করতে পারে। রেললাইনের উপর দিয়ে যেনতেনভাবে রাস্তা করলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যায়।’
রেল কর্মকর্তারা জানায়, লেভেল ক্রসিং ছাড়াও লোকোমাস্টারের অসাবধানতা, রেললাইনে ক্রুটি, সিগন্যালের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। এর আগে সিগন্যাল অমান্য করার কারণেও কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো মেইন লাইনে সর্বাত্মক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। লেভেল ক্রসিং নির্মাণের বিষয়ে প্রকৌশল দপ্তর আরও বেশি তদারকি করতে পারে। এমনকি লেভেল ক্রসিং আধুনিকায়নে প্রকল্প নেয়া হলেও সেগুলোও যথাসময়ে শেষ হয় না।
জানা যায়, কুমিল্লার ওপর দিয়ে যাওয়া আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার রেলপথ আছে। আখাউড়া, গঙ্গাসাগর, ইমামবাড়ি, কসবা, মন্দবাগ, সালদানদী, শশীদল ও রাজাপুর স্টেশনের উপর দিয়ে ট্রেন চলাচলে সময় লাগে এক ঘণ্টা ১০ মিনিট। এই ৭২ কিলোমিটারে ৬১টি রেল ক্রসিং আছে। এর মধ্যে ৩৮টি ক্রসিং অবৈধ। এসব অবৈধ রেলক্রসিংয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটিতে গেটম্যান দেওয়া হলেও বাকিগুলো অরক্ষিতই রয়ে গেছে। গত তিন বছরে এসব ক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে কমপক্ষে অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
রেলওয়ে পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ডাবল লাইন করার আগে এই ৭২ কিলোমিটারে প্রায়সময় দুর্ঘটনা ঘটলেও গত এক বছর ধরে তুলনামূলকভাবে দুর্ঘটনা কমে আসছে। লেভেল ক্রসিংগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে দুর্ঘটনা আরও কমে যাবে। ডাবল লাইন প্রকল্পের আওতায় ডুয়েলগেজ রেল ট্র্যাক, ১৩টি বড় সেতুসহ মোট ৪৬টি ছোটবড় সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এই রুটে কম্পিউটারাইজড সিগন্যালিং ব্যবস্থাসহ আখাউড়া ও লাকসাম রেলস্টেশনসহ ১১টি বি-ক্লাস রেল স্টেশন নতুন করে নির্মিত হওয়ায় দুর্ঘটনা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে।
আখাউড়া থেকে নাঙ্গলকোট পর্যন্ত রেলপথটি দুর্ঘটনাপ্রবণ। প্রতিনিয়ত এই রুটে দুর্ঘটনা ঘটলেও ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে আখাউড়া পৌরশহরের খড়মপুরে আন্তঃনগর পারাবাত এক্সপ্রেস রেলসেতু পারাপারের সময় ট্রেনের ধাক্কায় চারজনের মৃত্যু হয়। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি আখাউড়ায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী ঢাকা মেইল ট্রেনটি। ট্রেন চালকের ভুলের কারণে স্টেশনের বদলে অন্য লাইনে ঢুকে পড়ে ট্রেনটি। পরক্ষনে ভুল পথে ট্রেন চলছে সেটি বুঝতে পেরে অন্য স্টেশনের প্রায় ১০০ গজ দূরে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে গেলে বড়ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় হাজার খানেক যাত্রী। এই রুটে সবচেয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে। কসবার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন ত‚র্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস ও চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ১৭জন নিহত হয় এবং ৬০জন আহত হয়। এই দুর্ঘটনার জন্য ত‚র্ণা নিশীথা ট্রেনের চালক, সহকারী চালক ও গার্ডকে দায়ী করে তদন্ত কমিটি। চলতি বছরের ১৭মার্চ রেল লাইন বেঁকে যাওয়ায় নাঙ্গলকোটে বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে ৯টি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব দুর্ঘটনায় রেলওয়ের গঠিত বিভিন্ন তদন্ত কমিটি ট্রেনযাত্রা নিরাপদ ও সুরক্ষিত করতে বিভিন্ন সুপারিশ দেয়। এরমধ্যে লেভেল ক্রসিং গেট নিরাপদ করতে উন্নত প্রযুক্তি সংযোজন, সিসি ক্যামেরা স্থাপন, স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম, জনবল সংকট দূর করা, রেললাইনের আশপাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে বড়ধরনের কোন উদ্যোগ নেই রেলের।