নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
ওসমান গণি চৌধুরী ষাট ও সত্তরের দশকের চট্টগ্রামের একজন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাউজান থানার গহিরা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা আলহাজ্ব জহুরুল হক চৌধুরী ও মাতা জুলেখা খানম। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, সংস্কৃতিসেবী ও সংবাদপত্রসেবী। তিনি জমিদার কালাচান চৌধুরীর চতুর্থ অধস্তন পুরুষ। পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সে সময়ের দেশের পরিস্থিতি তাঁকে ছাত্র জীবনেই রাজনৈতিক আবর্তে টেনে নিয়েছিলো। গভর্নমেন্ট এম ই স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি স্কুলের জেনারেল ক্যাপ্টেন মনোনীত হন। এ সুবাদে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জুনিয়র হাইস্কুল করার ক্ষেত্রে ছাত্রদের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তার সাথে যুক্ত থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম কলেজের তখনকার ছাত্র রাজনীতি তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৬৬-৬৭ ইংরেজি শিক্ষাবর্ষে বর্তমান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হতে সরকারি মুসলিম হাইস্কুলে ভর্তি হন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছিল। এ সময় ’৬৮-’৬৯ ছাত্র সংসদে তিনি সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) নির্বাচিত হন। এতে তাঁর প্রতিদ্ব›িদ্ব ছিলেন ডাকসু’র সাবেক জিএস ও ভিপি এবং সংসদ সদস্য, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আখতারুজ্জামান। একই সংসদে তাঁর সাথে নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমানে দেশের বরেণ্য আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। পরবর্তীকালে শাহদীন মালিক স্কুল পরিবর্তনের কারণে তাঁকে সংসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
’৭০ এর দশকে মুসলিম হাইস্কুলের একজন সচেতন ছাত্র হিসেবে এবং ছাত্র সংসদের নির্বাচিত নেতা হিসেবে ওসমান গণি ’৬৯ এর ছাত্র-গণজাগরণে মিটিং, মিছিল, ধর্মঘট ইত্যাদি সকল কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এ আন্দোলনে মওলানা ভাসানীর ছত্রছায়ায় চিনপন্থী কমিউনিস্টদের একটি অংশ “পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি’’ নামে দেশের স্বাধীনতা ও শ্রমিক শ্রেণীর সরকার কায়েমের জন্য গোপনে এবং প্রকাশ্যে পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন নামে কাজ শুরু করে। একজন প্রগতিশীল ছাত্রকর্মী হিসাবে তিনি এ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। ’৭১-এর ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ‘আসাদ দিবস’- এ উক্ত সংগঠনের একক আহবানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের লক্ষে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীকে সশস্ত্র প্রতিরোধের অংশ হিসাবে ২৩ মার্চ চট্টগ্রামে পার্টির সরবরাহকৃত বোমা দিয়ে তিনি এবং সহকর্মী সাদেক সাইফুর রহমান (বর্তমানে চট্টগ্রামের খ্যাতিমান শৈল্যচিকিৎসক) চেরাগী পাহাড়ের মোড়ের ‘ইউসিস’ (মার্কিন তথ্য কেন্দ্র) সেন্টারের সামনে কর্মরত পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালান এবং কৌশলে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসেন। সম্ভবত স্বাধীনতা সংগ্রামের ঊষা লগ্নে এ বোমা হামলাই ছিল চট্টগ্রামে প্রথম বোমা হামলা। পরদিন পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হয়। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তারা ব্যাকুল হয়ে উঠেন এবং চট্টগ্রাম কলেজ, সিটি কলেজ, মহসিন কলেজ প্রভৃতি কলেজের ল্যাবরেটরি থেকে বোমা বানানোর কেমিক্যালস সংগ্রহ করেন। এভাবে তিনি স্বাধীনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সদ্য স্বাধীন দেশকে পুনর্গঠনের জন্য অগ্রসর হয়েও সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা নিজস্ব ব্যানারে কাজ শুরু করেন। ছাত্র রাজনীতি সংগঠিত করার সাথে সাথে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে জনগণকে স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন ও দেশ পুনর্গঠনের জন্য ‘বাংলাদেশ ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী’ চট্টগ্রাম শাখা গঠন করে জনাব ওসমান এই শাখার দু’ দু’বার সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। স্বাধীনতা-পূর্বকালে এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ভাষা সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে এই সংগঠনের শহর শাখার সভাপতি এবং ’৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দে একই সংগঠনের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সহ-সভাপতি এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ’৭২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র থাকাকালে কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলে ছাত্র সংগঠনগুলি এর প্রতিবাদ জানায়। ওসমান তাঁর সংগঠনকে নিয়ে বেতন বৃদ্ধি প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখেন এবং বেতন বৃদ্ধি রোধ করতে সক্ষম হন। এই সময় চট্টগ্রাম কলেজের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। উল্লেখ, ৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সহযোগী হিসাবে পাঁচশত টাকা এককালিন ভাতা গ্রহণ করেন। ’৭৩ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। এ সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত ছিল। যাতায়াত সমস্যাকে কেন্দ্র করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় সমস্যা আন্দোলন’ নামে একটি নির্দলীয় সংগঠনের ব্যানারে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তিনি এ কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন। আহবায়ক ছিলেন সাবেক সাংসদ মরহুম ইব্রাহিম বিন খলিল।
অন্যতম যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন বিশিষ্ট ব্যাংকার রোসাঙ্গীর আলম বাচ্চু। এ আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যাতায়াত সমস্যা সমাধানে বাসের সংখ্যা ও রেলের বগির সংখ্যা বাড়ানোসহ অন্যান্য দাবি মেনে নিতে সম্মত হয়। এ সময় তিনি সাবেক মন্ত্রী অধ্যাপক আরিফ মঈনুদ্দীনের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের ৩৭ জনের একটি গ্রæপ নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খাল খনন কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে প্রথমে যশোরে প্রকল্প এলাকা ও পরে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সাথে মিলিত হন এবং প্রকল্পকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য চট্টগ্রামে অবদান রাখেন ’৭৬-৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। এ সংসদের সভাপতি ছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন সাংসদ ফজলে করিম চৌধুরী। ’৭৯ খ্রিস্টাব্দে জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল গঠনের উদ্যোগ নেন তখন তিনি চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে অনুষ্ঠিত র্যালীতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখার আহব্বায়ক নির্বাচিত হন। পরে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর উপস্থিতিতে মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। জনাব ওসমান মুসলিম হাই স্কুলের ’৭০ ব্যাচের পুনর্মিলনী পরিষদ গঠন করে আহবায়ক নিযুক্ত হন। মরহুম ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কীর নেতৃত্বে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক ফোরাম’ এর একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে কাজ করেন। ছাত্র ইউনিয়ন পুনর্মিলনী পরিষদ গঠন করে এর কোষাধ্যক্ষ পদে মনোনীত হন।
তিনি ’৯১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক ঈশান পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং এই পত্রিকার প্রথম ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিভিন্ন সাময়িকী সম্পাদনা ও জাতীয় পত্রিকায় লেখালেখি করেন। তিনি মাওলানা ভাসানী ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম শাখার যুগ্ম আহবায়ক ও সদস্য সচিব। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সেবামূলক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছেন।
ওসমান গণি চৌধুরী ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, রেয়াজউদ্দিন বাজার বনিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক মরহুম শেখ আফতাব উদ্দিন আহমদের কনিষ্ঠ কন্যা দিলরুবা খাতুনের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি ১ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক। পুত্র মুস্তাকিন আহমদ চৌধুরী হাসনাইন এলএলবি অনার্স শেষ করে এলএলএম ডিগ্রি নিয়েছেন এবং কন্যা রেহনুমা তারান্নুম (রাফসান) বিবিএ পাস।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিক