৬আবদুল্লাহ আল ছগীর, দৈনিক নয়াবাংলা এবং মুক্ত-বিবেক স্বাধীনতার বাহন সংবাদপত্র

1

এস.এম. জামাল উদ্দিন

চট্টগ্রামের কৃতিপুরুষ দৈনিক নয়া বাংলা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব-এর সাবেক সভাপতি মরহুম আবদুল্লাহ আল্ ছগীর সাহেবের ৩৪ তম মৃত্যুবার্ষিকীর এই দিনে আন্তরিকভাবে তাঁকে স্মরণ করছি। স্মৃতিচারণমূলক এ ক্ষুদ্র লেখাটি আশা করি বর্তমান প্রজন্মের লেখক, সাংবাদিক এবং সচেতন সংবাদপত্র পাঠকদের তাঁর সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করে তুলবে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর কৃতিপুরুষ, গড়দুয়ারা গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আল্ ছগীর সাহেবের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে নজুমিয়া লেইন পাথরঘাটায়, যখন সেখানে দৈনিক নয়বাংলা অফিস ছিল তখন থেকেই। অফিসে যেতাম সংবাদ, প্রেস বিজ্ঞপ্তি নিয়ে। প্রথম প্রথম আমি ভয়ে তাঁর নিকট যেতাম না। কিন্তু দূর থেকে ঐ মহৎ মানুষটির সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারা দৈনিক নয়াবাংলা পাঠ করে ভীষণ শ্রদ্ধা জানাতাম। এমনি সময়ে একদিন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের নির্বাচন উপলক্ষে তাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছার সুযোগ আমার হয়ে যায়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ দেশে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক আইন জারি করেন। আমি তখন সাংবাদিক ফোরামের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিচারপতি আবদুস সাত্তারের দুর্নীতিবাজ সরকারের এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। চট্টগ্রাম সাংবাদিক ফোরামের পক্ষ থেকে সেদিন এরশাদ সাহেবকে আমরা বলেছিলাম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। বলেছিলাম, আমরা আশা করবো সামরিক আইনের আওতায় মুক্তবুদ্ধির চর্চা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। এ বক্তব্যটি চট্টগ্রাম সাংবাদিক ফোরামের প্যাডে লিখে নিয়ে যাই দৈনিক নয়াবাংলা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবদুল্লাহ আল ছগীর সাহেবের পাথরঘাটাস্থ নয়াবাংলা কার্যালয়ে। তিনি আমার কাছ থেকে কাগজটি নিয়ে পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হাবিবুর রহমান খানের কাছে দিলেন। ভারতের কলিকাতা থেকে বামফ্রন্ট সরকারের একটি পত্রিকা দৈনিক বসুমতী তখন আমি নিয়মিত পড়তাম। সেই মুহূর্তে বসুমতী পত্রিকা আমার হাতে ছিল। ছগীর সাহেব বললেন, ওয়া জামাল, তোঁয়ার হাতত ইয়েন কি পত্রিকা, চাই…! দৈনিক বসুমতী হাতে নিয়ে জনাব আবদুল্লাহ্ ছগীর সাহেব উল্টাতে লাগলেন। দৈনিক বসুমতীর মূল সম্পাদকীয় ছিল। ‘রতনে রতন চিনে’। তিনি আগ্রহভাবে সম্পাদকীয়টি পড়তে লাগলেন, তারপর পাঠ শেষে মন্তব্য করলেন, এটা কি সম্পাদকীয়? রতনে রতন চিনে? সে সময় কিন্তু ভারতে ইন্দিরা কংগ্রেসের সাথে বামফ্রন্টের মধ্যে তুমুল হট্টগোল চলছিল। যেহেতু দৈনিক বসুমতী পত্রিকাটি বামফ্রন্ট সরকারের, স্বাভাবিকভাবেই তারা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সমালোচনার তীব্র আঙ্গুল তুলে ধরেছিল।
আমার আশ্চর্য লাগলো এই যে, ছগীর সাহেব দৈনিক বসুমতীর অন্য কোন পৃষ্ঠায় তেমন গুরুত্ব দিয়ে চোখ বুলালেন না। তিনি গুরুত্বের সঙ্গে ‘রতনে রতন চিনে’, সম্পাদকীয়টি মনোযোগ দিয়ে আগাগোড়া পড়লেন এবং পত্রিকাটি পরে আমাকে ফেরত দিলেন। সত্যিই ছগীর সাহেব রতন চিনতেন। কারণ, প্রত্যেক সংবাদপত্রেরই আসল পৃষ্ঠা হচ্ছে সম্পাদকীয় পৃষ্ঠা। আর একটি স্মরণীয় মুহূর্ত চিরদিন মনে থাকবে। ১৯৮৩-৮৪ সালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব নির্বাচন। নির্বাচনে আমি একজন প্রার্থী। নির্দলীয় প্রার্থী। নির্বাচন চলছে পাকিস্তানের বেসিক ডেমোক্রেসি অনুযায়ী। অর্থাৎ প্রথমে সবাই সাধারণ ভোটারদের ভোটে সদস্য নির্বাচিত হবেন। পরে নির্বাচিত সদস্যরাই কার্যকরী কমিটি নির্বাচন করবেন। দুটি প্যানেল নির্বাচন করছে। আমি প্যানেলের বাইরে নির্দলীয় প্রার্থী। যথারীতি ভোটের দিন ভোট পর্ব চলছে। হঠাৎ দুপুর ১২টার দিকে আবদুল্লাহ্ আল ছগীর সাহেব চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের (পুরাতন ভবন) ভিতর থেকে বের হয়ে হাসি দিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, ওয়া জামাল কথা শোন সচরাচর প্যানেলের বাইরে এসব নির্বাচনে কেউ নির্বাচিত হয় না। তখন প্রেস ক্লাব আঙ্গিনায় তখন দন্ডায়মান ছিলাম আমরা কয়েকজন যথাক্রমে সাংবাদিক মইনুদ্দীন কাদেরী শওকত, জি. আবুল কাসেম, এ.কে.এম. কামরুল ইসলাম চৌধুরী ও আমি এস.এম. জামাল উদ্দিন। তবে যত ভোট পাও তার মধ্যে মনে রাখবে একটি ভোট আমার। কারণ, তুমি আমার হাটহাজারীর ছেলে। তাই তোমাকে আমি একটি ভোট দিয়েছি। মাধুর্যে ভরা তার কথা। মমত্ববোধ এবং আন্তরিকতাপূর্ণ ছগীর সাহেবের বাচনভঙ্গীর দৃঢ়তা এবং বিচক্ষণতা চিরদিন আমার হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঐ সময় আমি ১০ (দশ) ভোট পেয়েছিলাম। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের নির্বাচনী ইতিহাসকে ঘিরে জনাব ছগীর সাহেবকে নিয়ে সে এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি আমার। আবদুল্লাহ আল ছগীর ৫ ছেলে ও. ৩ মেয়ের জনক। দৈনিক নয়াবাংলার বর্তমান সম্পাদনায় রয়েছেন তাঁর বড় ছেলে জিয়াউদ্দিন এম. এনায়েতউল্লাহ হিরু। মেজ ছেলে জেড.এম. এনামুল কাদের টিপু বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মকান্ডে নিয়োজিত, সেজ ছেলে বি.এম. মঞ্জুর এলাহী খোকন দৈনিক নয়াবাংলার ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। এস.এম. ফরমান এলাহী শাহীন ও বি.এম এহসানুল কাদের। বিশাল অন্তরের অধিকারী আবদুল্লাহ আল ছগীর স্পষ্টবাদী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং উপকারী মানুষ ছিলেন। তিনি অত্যন্ত পরহেজগার, সৎ ও চরিত্রবান লোক ছিলেন। উল্লেখ্য যে, মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম, কবি আবদুস ছালাম, হাবিবুর রহমান খান, এম.এ. কুদ্দুস, শরীফ রাজা, কবি ওহিদুল আলম, আবদুল্লাহ আল ছগীর, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, সায়ফুল আলম, বি.এ.আজাদ ইসলামাবাদী, সাধন ধর, নুর সাঈদ চৌধুরী, নজির আহমদ, বিমলেন্দু বড়ুয়া, সৈয়দ মোস্তফা জামাল, মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী, আ.জ.ম.ওমর, এস.এম.আফজল মতিন সিদ্দিকী, ওসমানুল হক, শিব্বির আহমদ সিদ্দিকী, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী, ইমামুল ইসলাম লতিফী, এম. ওবায়দুল হক, মোহাম্মদ মোসলেম খান, মঈনুল আলম, প্রমুখের মত সাংবাদিকরাই চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাই তাদেরকে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
সংবাদপত্র প্রকাশ করে ছগীর সাহেব জাতীয় প্রেক্ষাপটে একটি দায়িত্বশীল সম্পাদক রূপে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আবদুল্লাহ আল ছগীর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক নয়াবাংলাকে প্রথম শ্রেণীর দৈনিক উন্নীত করতে সক্ষম হন। দৈনিক আজাদীর পর পরই সেই সময় নয়াবাংলা এখানে, বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করছিল। ঘাত-প্রতিঘাতে প্রতিনিয়ত জর্জরিত এখানকার সংবাদপত্র শিল্প। বর্তমানে রাজধানীর কিছু কিছু সংবাদপত্র এক শ্রেণীর কালোবাজারী, মজুদদার ও নব্য কোটিপতিদের দখলে।
চট্টগ্রামের সংবাদপত্র জগতে দৈনিক নয়াবাংলা জনকল্যাণের ক্ষেত্রে বেশ আশাবাদ সৃষ্টি করেছিল।আবদুল্লাহ্ আল্ ছগীর সাহেবের সংবাদপত্র প্রকাশের পেছনে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। সমাজের বড়, ছোট সকলের সঙ্গে, সু-সম্পর্ক ছিল তাঁর। তিনি আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছেন দীর্ঘ ৩৪ বছর আগে আজও তাঁর আদর্শ আমাদের উজ্জীবিত করে। ১৯৯১ সালের ২৯ মার্চ তিনি নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। আবদুল্লাহ আল ছগীর, দৈনিক নয়াবাংলা এবং মুক্ত-বিবেক স্বাধীনতার বাহন সংবাদপত্র এ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, মরহুম ছগীর সাহেবের আদর্শকে সামনে রেখে যদি দৈনিক নয়াবাংলা প্রকাশিত হয় তাহলে ভবিষৎ প্রজন্ম দিক-নির্দেশনা পাবে। দৈনিক নয়াবাংলার প্রকাশনা জনস্বার্থ নিরাপদ রাখার জন্যও দরকার বলে আমার বিশ্বাস। আমি মরহুম আবদুল্লাহ আল ছগীর সাহেবের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। পরিশেষে দৈনিক নয়াবাংলার সমৃদ্ধি ও সাফল্য কামনা করছি।
লেখক: কেন্দ্রীয় সভাপতি- বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক সংস্থা। বিশেষ সংবাদদাতা, দৈনিক নয়াবাংলা, চট্টগ্রাম