হাটহাজারী প্রতিনিধি
দিনটি ছিল ৫ আগস্ট। সেদিন শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও সেনাপ্রধানের বক্তব্য দেওয়ার পর বিকেলে ছাত্র-জনতা, বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মীরা আনন্দ মিছিল ও উল্লাস পরবর্তী বিজয় মিছিলে অংশ নেয় স্যানিটারি মিস্ত্রি মোহাম্মদ দিলদার (২৫)। মিছিল শেষে পরিবারের জন্য বাজার করতে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের হাটহাজারী পৌরসভার কাচারী সড়ক অতিক্রম করে রঙ্গিপাড়া রুটস্থ কাঁচা বাজারের প্রবেশ করার আগেই ত্রিবেণী মোড়ে বিদ্যুতের খুটির সামনে আসলে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। ওই মুহূর্তে দক্ষিণ দিক থেকে আসা গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপতালে নিয়ে যায়।
পরবর্তীতে এলাকাবাসীর চাঁদার টাকা দিয়ে চিকিৎসা নিয়ে কোনমতে প্রাণে বাঁচলেও কেটে ফেলতে হয়েছে তার ডান পা। ঘটনার একটি মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও টাকার অভাবে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে বাড়িতে বিছানায় শুয়ে ব্যথার যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড দেওয়ান নগর এলাকার মৌলভী পাড়ার আবদুল জলিলের বাড়ির পঙ্গু মো. তৈয়বের পুত্র দিলদার। অভাবের সংসারে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তার পরিবারের সদস্যরা তাকে (দিলদার) উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছেন না। কারণ দিলদারই ছিল তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অথচ দীর্ঘ একটি মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও কেউ দিলদারের খবর নেয়নি। গুলিবিদ্ধ হয়ে পা হারানোর পর আয়-রোজগার না থাকায় মা-বাবাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে দিলদারকে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সরেজমিন বাড়িতে গেলে কথা হয় শয্যাশায়ী দিলদার ও তার মা-বাবার সাথে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে পা হারানোর দিলদার সেই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুুত হয়ে বলেন, কোটা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পরবর্তী ৫ আগস্ট বিজয় মিছিল শেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে পৌরসভার কাচারী সড়ক অতিক্রম করার পর তিনি গুলিবিদ্ধ হবার বর্ণনা দেন। স্থানীয় লোকজন আমাকে উদ্ধার করে প্রথমে পৌরসদরের একটি বেসরকারি হাসপতালে, পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল থেকে অজ্ঞাত কারণে ৬ আগস্ট ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে স্থানান্তর করে দেয়। যদিও আমার পায়ে গুলি লাগা ছাড়া কোন সমস্যা ছিল না।
তিনি আরও জানান, ওই দিনই জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট থেকে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলেও দুই দিন কোন চিকিৎসক তাকে দেখতে আসেনি। এমতাবস্থায় আমার পায়ে ইনফেকশনের পরিমাণ বাড়তে থাকায় আমাকে ফের কোন চিকিৎসা না দিয়ে পুনরায় চমেক হাসপাতালে হস্তান্তরের পরামর্শ দিতে থাকে। এভাবে দীর্ঘ সময়ের যাতায়াতে আমার নিজের ও পায়ের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে উঠে।
এতে আর কোন উপায়ান্তর না দেখে রাজধানীর মিরপুরস্থ হাই কেয়ার অর্থোপেডিকস অ্যান্ড জেনারেল হসপিটালে ভর্তি হই। অতিরিক্ত ইনফেকশনের কারণে হাই কেয়ার অর্থোপেডিকস অ্যান্ড জেনারেল হসপিটালের চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক গত ৭ আগস্ট বিকেলে আমার ডান পা কেটে ফেলা হয়।
বিগত এক মাসে এলাকাবাসীর দেয়া ২-৩ লাখ চাঁদার টাকা দিয়ে চিকিৎসা নিয়ে কোন রকমে আমার ছেলে দিলদারকে প্রাণে বাঁচাতে পারলেও বর্তমানে টাকার অভাবে চিকিৎসার সেবা না পেয়ে বাড়িতে বিছানায় শুয়ে ব্যথার যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন বলে জানান তার গর্ভধারিনী মা রোকেয়া বেগম। তিনি আরও জানান, তার পারিবারিক অবস্থা খুবই শোচনীয় হওয়ায় ছেলের চিকিৎসা খরচ ও পরিবার পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। অভাবের সংসারে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছেলেকে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছি না।
ঘটনার দীর্ঘ একটি মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রশাসনের কেউ দিলদারের খবর নেয়নি-এমনটা দাবি করে গুলিবিদ্ধ হয়ে পা হারানোর দিলদারের পঙ্গু বাবা মো. তৈয়ব জানান, আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে ছিল দিলদার। এরমধ্যে একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা পরবর্তী তার ডান পা কেটে ফেলতে হলো। কি হবে তার ভবিষ্যৎ, তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছি। তারমধ্যে প্রতিদিন প্রায় ৮০০-৯০০ টাকার ওষুধ লাগে। এত টাকা আমি কোথায় পাব? আমার ছেলের চিকিৎসা, সংসারই বা চলবে কিভাবে? সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতার চাই।
এ বিষয়ে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ বি এম মশিউজ্জামান বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে পা হারানো আহত দিলদারের বিষয়ে আমার ও আমাদের প্রশাসনের কারো জানা ছিল না। আমি খুব দ্রæত আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে খোঁজ খবর নেব।