মো. সাইফুল মিয়া
সবুজ পাহাড়ে ঘেরা এবং অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মোড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবার ৫৯ বছরে পা রাখল। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর হাটহাজারী উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের জোবরা গ্রামে ২১০০ একরের বিস্তীর্ণ ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের অন্যতম এই বিদ্যাপীঠ। শুরু থেকেই জ্ঞান, শিক্ষা, ও গবেষণার কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘ ৫৮ বছরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি হয়েছে অসংখ্য জ্ঞানী, গুণী ও পেশাজীবী, যারা দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাÐেও বিশ্ববিদ্যালয়টির রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষকগণ বরাবরই সোচ্চার থেকেছেন, তাঁদের অবদান জাতির জন্য চিরস্মরণীয়। এই দীর্ঘ যাত্রায় বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি হয়ে উঠেছে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার।
দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ‘৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ জুলাই বিপ্লবেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন, যেখানে হৃদয় তরুয়া এবং ফরহাদ নামের দুই মেধাবী শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছেন।
প্রতিষ্ঠার সময় মাত্র ৮ জন শিক্ষক, ৪টি বিভাগ এবং ২০৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এখানে ৯টি অনুষদের অধীনে রয়েছে ৪৮টি বিভাগ এবং ৬টি ইনস্টিটিউট, যেখানে ১ হাজার ২শ গুণী শিক্ষক কর্মরত আছেন। শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের একটি হিসেবে স্বীকৃত। গণতন্ত্র চর্চা, অসা¤প্রদায়িক সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে এই বিশ্ববিদ্যালয় আজও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেন সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি অনন্য। ১৯৮০ সালে শহরের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন এবং শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের দুর্ভোগ কমানোর লক্ষ্যে শাটল ট্রেন চালু করা হয়। এই ট্রেন শুধু একটি পরিবহন মাধ্যম নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর আবেগের প্রতীক। শাটল ট্রেনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের অসংখ্য স্মৃতি, গল্প এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে শাটল ট্রেন যাত্রার এই দীর্ঘ সময় পরেও এর অব্যবস্থাপনা ও সীমাবদ্ধতা দূর হয়নি। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের স্বস্তির শাটল ভোগান্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ১৪টি আবাসিক হল এবং ১টি ছাত্রাবাস, যার মধ্যে ৯টি হল ছেলেদের জন্য এবং ৫টি হল মেয়েদের জন্য নির্ধারিত। তবে এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর তুলনায় আবাসন ব্যবস্থা এখনও অপ্রতুল, কারণ এই হলগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ২১ শতাংশের আবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। বাকি ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বাধ্য হয়ে ব্যক্তিগত ব্যবস্থায় থাকতে হচ্ছে, যা বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ এবং দৈনন্দিন যাতায়াতে নানা অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবাসন সংকটের এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধার একটি বড় সীমাবদ্ধতা হিসেবে রয়ে গেছে, যা শিক্ষার্থীদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাত্র ৪ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতাকে সীমিত করেছে। একইভাবে, চাকসু নির্বাচন ৫৮ বছরে মাত্র ৬ বার অনুষ্ঠিত হয়েছে, শেষটি প্রায় ২৯ বছর আগে। এতে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব বিকাশ ও অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠার ৫৮ বছর পরও ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যা শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক উন্নয়ন এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক উন্নয়নে এসব ঘাটতি বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের শেষ নেই। নাপা আর ওমিপ্রাজল ছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধ মেলে না। সময়মতো অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়া, জরুরি ওষুধের ঘাটতি এবং সীমিত সুযোগ-সুবিধার কারণে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য শহরে ছুটতে হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই মানসিক কাউন্সেলিং সেন্টার। শিক্ষার্থীদের আতœহত্যা প্রবণতা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক কাউন্সেলিং ব্যবস্থা থাকলে শিক্ষার্থীরা তাদের মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও হতাশা থেকে মুক্তি পেতে পাবে এবং আত্মহত্যা প্রবণতা কমবে। এতকিছুর সত্তে¡ও আক্ষেপের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তি অজস্র। শিক্ষার্থীদের এই আক্ষেপগুলো পূরণ করতে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সুনজর এবং যথাযথ উদ্যোগ কামনা করছি। সর্বোপরি, গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় অগ্রগামী হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাতি ও দেশের পথপ্রদর্শক হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক