৪ বছর ৩ মাসে ২৩ দুর্ঘটনায় ২২ মৃত্যু, আহত ৭৪

1

মো. শাহাদাত হোসেন, চন্দনাইশ

সারা বাংলাদেশের ২৩টি মহাসড়কের মধ্যে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি। এ মহাসড়কে যত্রতত্র কাভার্ড ভ্যান-বাস-ট্রাক-সিএনজি অটোরিকশার সাথে সংঘর্ষে ও দুর্ঘটনায় ২০২১ সাল থেকে চলতি এপ্রিল মাস পর্যন্ত ২৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৭৪ জন। আহতদের মধ্যে অনেকের অঙ্গহানী ঘটে আজ প্রতিবন্ধীত্ব বরণ করতে হয়েছে। অধিকাংশ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বেপরোয়া গতি, পথচারীদের অসচেতনতা। পাশাপাশি নসিমন, করিমন, ভটভটি, ব্যাটারি রিকশা, টমটম ও সিএনজি অটোরিকশার অযাতিত চলাচল, উল্টোপাশ দিয়ে বেপোরোয়াভাবে বিভিন্ন যানবাহনের চলাচলের কারণে ঘটছে অধিকাংশ দুর্ঘটনা। প্রযুক্তির মাধ্যমে গতি নজরদারি, চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, সাধারণ পথচারীদের চলাচল সচেতনতা, সর্বোপরি মহাসড়কে ব্যাটারি রিকশা, টমটম, নসিমন, ভটভটি ও তিন চাকার সিএনজি অটোরিকশার চলাচল বন্ধ করার পাশাপাশি মহাসড়কটির দুইপাশ সম্প্রসারণ অতীব জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও সচেতন মহল। এছাড়াও লবণ পরিবহনের সময় সড়কে যেন লবণের পানি পড়ে পিচ্ছিল না হয় সেই বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ ও এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়েও পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর ২ সন্তানসহ বান্দরবানে স্বামীর সাথে শুটিং সেটে যাওয়ার পথে চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া মাজার পয়েন্ট এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারান তৎকালীন সুপার স্টার চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। এ সময় তার দুই সন্তান ও আরেক অভিনেতা প্রয়াত এটিএম শামসুজ্জামানও আহত হন। এই দুর্ঘটনাটি ব্যাপক আলোড়ণ তুলেচিল সেই সময়কালে। প্রিয়তমা স্ত্রীর এমন মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। আর যেন এই ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার কেউ না হন সেই জন্য তিনি লাইট-ক্যামেরা, আ্যকশনের চিরচেনা রঙিন ভুবন ছেড়ে রাজপথে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন শুরু করেন যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
জানা গেছে, একই স্থানে ১৯৮৭ সালের ২১ এপ্রিল একজন ম্যাজিস্ট্রেটের ১২ বছর বয়সী সন্তান শাহরিয়ার কামাল ¯িœগ্ধ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। ঐ সময় তার বাবা সেই ম্যাজিস্ট্রেট ¯িœগ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে মাজার পয়েন্ট ব্রিজের উত্তর পাশে শাহরিয়ার কামাল ¯িœগ্ধ সড়ক নামে একটি পাখির স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে দেন। সে থেকে ঐ জায়গাটির নাম পক্কীমার্কা এলাকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ২০২৪ সালের ২৫ মার্চ মাজার পয়েন্ট ব্রিজের দক্ষিণ পাশে হাইওয়ে পুলিশের হাতে ধরা না পড়তে পালাতে গিয়ে একটি অটোরিকশা উল্টে আগুন লেগে যায়। সেই আগুনে পুড়ে মারা যান অটোরিকশাটির চালক আবদুস ছবুর।
প্রশস্ত সড়ক, বিপদজনক বাঁক, বেপরোয়া গতির যান চলাচল, লবণ পানিতে পিচ্ছিলতা সৃষ্টি, নিষিদ্ধ ছোট যানবাহন চলাচল এবং উল্টোপথে যানবাহন চলাচলের কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটিতে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল কোনোভাবেই থামছে না। তাছাড়া অন্য জেলার চালকদের এ সড়কে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে ব্যস্ততম এ সড়কে মৃত্যুর মিছিল সম্প্রসারিত হচ্ছে।
সঙ্গত কারণে মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীত করা, লবণবাহী ট্রাক, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীরা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে ৬ লেনে উন্নীত করার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে স্মারকলিপি, গণস্বাক্ষর, পদযাত্রা শুরু হয়েছে। ঈদ পরবর্তী লোহাগাড়ার জঙ্গলিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় ১১ জনের মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। এ সড়কে ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩০ কিলোমিটার সড়ক সরু, বাঁক রয়েছে শতাধিক। কর্তফুলী শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণ পাড় থেকে লোহাগাড়ার শেষ সীমানা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার মহাসড়কে ১০টি স্থানে গড়ে উঠেছে অবৈধ টার্মিনাল। সে সাথে অটোরিকশার পাশাপাশি মহাসড়কে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে এ সকল অবৈধ টার্মিনাল ও মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ ঝুঁকিপূর্ণ এসব বাহন চলাচল করলেও কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়না সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে। সড়কের বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে গড়ে উঠা সিএনজি অটোরিকশা, টেম্পু, যাত্রীবাহী হাইচ-মাইক্রো স্টেশনগুলো উচ্ছেদ না করায় যানজট যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে প্রাণহানি-অঙ্গহানি হওয়ার মতো মারাত্মক দুর্ঘটনা।
জানা গেছে, চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি গাছবাড়িয়া যাত্রী ছাউনীর সামনে যাত্রীবাহী ২ বাসের মুখোমূখি সংঘর্ষে চালকসহ ৭ জন আহত হন। ২৪ জানুয়ারি মাজার পয়েন্ট ব্রিজের উত্তর পাশে সড়ক পারাপারের সময় হেফজখানার শিক্ষার্থী মিশকাতুল ইসলাম (৯) যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় নিহত হয়। ২৫ জানুয়ারি রাতে রৌশনহাট এলাকায় বালুর ট্রাকে চাপা পড়ে মোটরবাইক আরোহী মো. রোমান নিহত হয়। ২৭ জানুয়ারি দোহাজারী বিওসি মোড়ে অটোরিকশা ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নাঈম উদ্দীন (২৩) নামের একজন নিহত হয়, ৩ জন আহত হয়। ২৮ ফেব্রæয়ারি রাতে মাজার পয়েন্ট ব্রিজে ডিভাইডারের সাথে ধাক্কা লেগে টমটম আরোহী মো. রাসেল নিহত হয়। ১৩ মার্চ দোহাজারী সদরে যাত্রীবাহী পূরবী বাস ব্যাটারিচালিত রিকশাকে চাপা দিলে স্কুল শিক্ষার্থী ওয়াকার উদ্দিন আদিল (১৩), উম্মে হাবিবা রিজভী (১৫), রিকশা চালক রুহুল আমিন (৪৫) ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এই ঘটনায় আহত হয় ১ শিক্ষার্থী। ১৪ মার্চ দোহাজারী ব্রিজের দক্ষিণ পাশে একটি অটোরিকশার সাথে ট্রাকের ধাক্কায় চালক গুরুতর আহত হন। চলতি এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ সকালে দোহাজারী দেওয়ানহাট মোড়ে যাত্রীবাহী পূরবী বাসের ধাক্কায় রিকশাচালক জাহাঙ্গীর আলম (২২) নিহত হন, আহত হন ২ যাত্রী। জানা গেছে, মহাসড়কটিতে ২০২১ সালে ৭ দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত, ১৫ জন আহত, ২০২২ সালে ৯টি দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত, ৩২ জন আহত হন। ২০২৩ সালে ৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৩ জন, আহত হন ৮ জন, ২০২৪ সালে ২টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ২ জন, আহত হন ৩ জন, ২০২৫ সালে ৬টি দুর্ঘটনায় ৮ জন নিহত, ১৬ জন আহত হন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশ অংশে রৌশনহাট, বাদামতল, গাছবাড়ীয়া কলেজ গেইট, দোহাজারী সদর, দোহাজারী বিওসি’র মোড়, সড়ক ও জনপথ বিভাগের সামনের এলাকা ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ ট্রাক, বাস, অটোরিকশা স্টেশন। প্রত্যেকটি স্থানে সড়কের দুই পাশে সারি সারিভাবে রাখা হয় বাস, ট্রাক, সিএনজি অটোরিকশা। কোনো কোনো স্থানে মহাসড়কের উপরেই গ্যারেজ বানিয়ে বাস-ট্রাক-টেম্পু, সিএনজি অটোরিকশা মেরামত ও ধোয়ামোছার কাজ চালাচ্ছে বিনা বাধায়। বিশেষ করে শঙ্খ নদীর দক্ষিণ পাশে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে ফুটপাতবিহীন মহাসড়কে স্থায়ীভাবে বাস ও ট্রাক পার্কিং করা হচ্ছে নিয়মিত। ফলে এ সড়কে চলাচলরত শিক্ষার্থী, পথচারীদের দুর্ভোগ ছাড়াও যানজট লেগে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা।
স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মহাসড়কে চলাচল নির্বিঘ্ন করতে থ্রি-হুইলার, ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ আইন না মানার কারণে দুর্ঘটনার ভয় লেগেই থাকে।
দোহাজারী হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ শুভ রঞ্জন চাকমা বলেন, মহাসড়কের পাশে গাড়ি না রাখতে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে একাধিকবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া মহাসড়কে তিন চাকাবিশিষ্ট যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ থাকার বিষয়টি যথাযথভাবে বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।