মনিরুল ইসলাম মুন্না
ঋণ খেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি, পলাতক ঋণ খেলাপিদের দেশে ফিরিয়ে আনা, বন্ধক রাখা সম্পত্তির জন্য তত্ত¡াবধায়ক (রিসিভার) নিয়োগ এবং ঋণ খেলাপিদের উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো বেশ কিছু সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতের যুগ্ম জেলা জজ মুহাম্মদ মুজাহিদুর রহমান। তাছাড়া ৪ বছর ৩ মাস সময়কালে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে ৫ হাজার ৩০টি মামলা নিষ্পত্তি করেন মুজাহিদুর রহমান। একই সময়ে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক পদ থেকে বিদায় নেন মুজাহিদুর রহমান। এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপনমূলে তাকে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত থেকে বদলি করে আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। দায়িত্ব পালনকালে তিনি চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতকে খেলাপি ঋণ আদায়ে একটি কার্যকর আদালত হিসেবে দৃশ্যমান করে তোলেন। বিচারক মুজাহিদুর রহমান যোগদানের পর অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়তে শুরু করে। তিনি যোগদানের পর ২০২১ সালে যেখানে মামলা নিষ্পত্তি হয় ৫৪২টি, সেখানে পরবর্তী তিন বছর গড়ে ১ হাজার ৩০০-এর বেশি মামলা নিষ্পত্তি হয়।
অর্থঋণ আদালতের সদ্য সাবেক বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম শাহেদ বলেন, স্যার যোগদান করার পর খেলাপি ঋণ আদায়ে তিনি কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি যোগদানের পর গত ৪ বছর ৩ মাস সময়কালে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে ৫ হাজার ৩০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। একই সময় সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা।
জানা গেছে, গত চার বছরে এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলম, আরামিট গ্রগ্রুপের সাইফুজ্জামান চৌধুরী, হাবিব গ্রগ্রুপ, মেসার্স ইলিয়াস ব্রাদার্স-রিজেন্ট এয়ারওয়েজের মূল প্রতিষ্ঠান মাহিন এন্টারপ্রাইজের আশিকুর রহমান লস্করসহ অন্যান্য বড় ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ফরমান ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন তিনি।
চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন বিভিন্ন মামলায় জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তারা বিচারক মুজাহিদুর রহমানের এই বদলির ব্যাপারে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
অর্থঋণ আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে নিষ্পত্তি হয়েছিল ৫৪২টি মামলা। একই সময় আদালতে অর্থঋণ ও জারি মামলা দায়ের হয়েছিল ১ হাজার ১৭৪টি। এসব মামলা থেকে ওই বছর আদালত খেলাপি ঋণ আদায় করে ৫৫৭ কোটি টাকা। একইভাবে ২০২২ সালে নিষ্পত্তি হয়েছিল ১ হাজার ৫৮৮টি মামলা। ওই বছর আদালতে অর্থঋণ ও জারি মামলা হয়েছিল ১ হাজার ৪৬৮টি। এসব মামলা থেকে খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছিল ৮৯৮ কোটি টাকা। আর ২০২৩ সালে নিষ্পতি হয়েছিল ১ হাজার ৬০৬টি মামলা। একই বছর অর্থঋণ ও জারি মামলা হয়েছিল ২ হাজার ১৮৯টি। আর এসব মামলা থেকে ৯৮৫ কোটি খেলাপি ঋণ আদায় করেন আদালত। সর্বশেষ ২০২৪ সালে নিষ্পত্তি হয়েছিল ১ হাজার ১৪৪টি মামলা। একই সময়ে অর্থঋণ ও জারি মামলা হয়েছিল ১ হাজার ৮০৯টি। আর এসব মামলা থেকে ৯৯৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করেন আদালত। একইভাবে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের বন্ধক সম্পত্তির মালিকানা ব্যাংকের কাছে এসেছে।
আদালতের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধ করেছে। এসএ গ্রুপ ৪৪০ কোটি টাকা, মোস্তফা গ্রুপ ২৯৫ কোটি টাকা এবং ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ১১৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এর বাইরে, কেডিএস গ্রুপের এক পরিচালক ১০৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন।
এর আগে ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত। সিটি ব্যাংকের দায়ের করা এক মামলার ভিত্তিতে হিলসভিউ এন্টারপ্রাইজের ‘ফোরাম সেন্ট্রাল বিল্ডিং’ নামে বন্ধক রাখা বাণিজ্যিক সম্পত্তির জন্য তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয়। এর ফলে, প্রতিষ্ঠানটি ২৩ কোটি টাকার বেশি ঋণ পরিশোধ করে। ২০২৩ সালে ‘মহল মার্কেট’র বন্ধক রাখা সম্পত্তি নিয়ে একটি সমঝোতা করেন আদালত, যার মাধ্যমে ৬০ কোটি টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়। ইতোমধ্যে ৫১ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে মহল মার্কেট।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস.এম দিদার উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি বিবাদীপক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করলেও এটি সত্য যে, সদ্য সাবেক বিচারক মুজাহিদুর রহমান মহোদয়ের সময়কালে অর্থঋণ আদালতের কার্যক্রম অনেক বেশি গতিশীল ছিল। বিশেষ করে ২০২১ থেকে ২০২৪ এই সময়ে দেশে যখন ডলার ক্রাইসিসের কারণে দেশের ব্যাংকগুলো অর্থ সংকটে ভুগছিল। তখন তিনি বিবাদীদের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বিদেশ যাওয়া রোধ করেছেন। তার কঠোর অবস্থানের কারণে এই চার বছরে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে। আমরা আশা করছি, সামনেও অর্থঋণ আদালতের কার্যক্রম এ রকম গতিশীল থাকবে। এখন যিনি বিচারক নিযুক্ত হয়েছেন, তিনিও আগের বিচারকের ধারাবাহিকতায় খেলাপি ঋণ আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ নেবেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সিনিয়র ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ, সম্পত্তি জব্দ, বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, পাসপোর্ট জব্দ এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মতো ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে গত কয়েক বছরে ঋণ আদায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে এসব উদ্যোগ অনেক ঋণ খেলাপিকে ক্ষুব্ধ করেছে। বিচারক মুজাহিদ স্যারকে বদলি না করে আরও বড় পরিসরে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।’