৪০ হাজার মানুষের ৩ বছরের ‘দুর্দশা’ ঘুচলো ৬ মাসে

9

মনিরুল ইসলাম মুন্না

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ছাড়া নাগরিক জীবন অনেকটা ‘অচল’। কারণ, নিজস্ব পরিচিতি থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি সেবা নিতে হলে এনআইডি বাধ্যতামূলক। কিন্তু এনআইডি করতে গিয়ে নানা ভুল-ভ্রান্তির ফাঁদে পড়ে যান অনেকে। সেগুলো সংশোধন করতে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়েছে নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে।
চট্টগ্রামে গত ৩ বছরে সেই ধরনের আবেদন নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণেছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। তাদের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেছে গত ৬ মাসে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রামের’ আওতায় তারা দীর্ঘদিনের দুর্দশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন, হাতে পেয়েছেন কাক্সিক্ষত এনআইডি।
গতকাল রবিবার দুপুরে সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বশির আহমেদ এর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তার কক্ষের টেবিল ঘিরে কাজে মগ্ন ৫ জন কর্মকর্তা। তাদের দম ফেলার ফুরসৎ নেই। তারা ল্যাপটপে কাগজপত্র যাচাই, সংশোধন ও সফটওয়্যারে এন্ট্রির কাজে ব্যস্ত। তাদের দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন বশির আহমেদ, কাগজপত্র ঠিকঠাক পেলে অনুমোদন করছেন।
বশির আহমেদ জানান, তার কার্যালয়ে ৩ বছর ধরে জমতে থাকা আবেদন নিষ্পত্তিতে ৬ মাসের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করা হয়। ৩০ জুন ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মেয়াদ শেষ। গতকাল রবিবার তাই কাজের তাড়াও বেশি। এরই মধ্যে গতকালই ৩৯ হাজার ৭৮৩টি আবেদন নিষ্পত্তি করে শূন্যে নামিয়ে আনা হয়েছে। এ কার্যালয়ে আর কোনো আবেদন অপেক্ষমাণ নেই।
তিনি আরও বলেন, ‘ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমরা প্রতিটি আবেদন যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন করে দিয়েছি। এর মধ্যে যেসব আবেদনে যথাযথ কাগজপত্র জমা দিতে পারেনি, সেসব আবেদন আমরা বাতিল করেছি। তবে যাদের আবেদন ইতোমধ্যে বাতিল হয়েছে, তারা প্রয়োজনীয় কাগজ যুক্ত করে পুনরায় আবেদনের সুযোগ পাবে। নাগরিকদের উদ্দেশে বলতে চাই- আপনারা মধ্যস্থতাকারী বা মিডিয়া না ধরে সরাসরি কর্মকর্তার সহায়তা নিবেন এবং তাদের পরামর্শমত কাজ করবেন।
বশির আহমেদ বলেন, ‘আমি যেদিন চট্টগ্রাম অফিসে যোগদান করি সেদিন দুই ক্যাটাগরিতে ৩৫ হাজার ৬১৩টি এনআইডি সংশোধনের জন্য পেন্ডিং (অপেক্ষমাণ) ছিল। ক্র্যাশ প্রোগ্রামের ‘গ’ ক্যাটাগরিতে থাকা আরও চার হাজার ১৭০টি আবেদন পেন্ডিং ছিল। আমি রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজ (রবিবার) বিকেল ৫টায় সংশোধনের এসব আবেদন নিষ্পত্তি করেছি। দীর্ঘদিন এসব এনআইডি সংশোধনের আবেদন অনিষ্পন্ন ছিল। এতগুলো অনিষ্পন্ন এনআইডি সংশোধন করতে অমানবিক পরিশ্রম হয়েছে। আমার আটজন সহকর্মী পাশে ছিলেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। পরবর্তীতে যেসব আবেদন আসবে, কাগজপত্র ঠিক থাকলে সেগুলোও তিন কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করে ফেলব।
জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার পদে যোগদান করেন মোহাম্মদ বশির আহমেদ। তিনি যোগদানের সময় পেন্ডিং আবেদন ছিল ‘খ’ ক্যাটাগরিতে ৩১ হাজার ৩৭৬টি এবং ‘খ এর ১’ ক্যাটাগরিতে চার হাজার ২৩৭টিসহ মোট ৩৫ হাজার ৬১৩টি। ‘গ’ ক্যাটাগরির চার হাজার ১৭০টি আবেদন। এরপর টানা ৬ মাস সেগুলো নিষ্পত্তির কার্যক্রম চলে, যা গতকাল রবিবার বিকেলে সম্পন্ন হয়েছে। এসব আবেদন নিষ্পত্তিতে নিয়জিত ছিলেন মোহাম্মদ বশির আহমেদসহ ৯ জন কর্মকর্তা। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এসব আবেদন নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, আমার অফিসে ‘গ’- ক্যাটাগরির কিছু আবেদন পেন্ডিং রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ তদন্তাধীন থাকায় নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। বাকিগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে। আমার এখানে ১৭ হাজারের বেশি আবেদন ছিল। এরই মধ্যে এক হাজারের মত বাকি আছে। সেগুলোও তদন্ত রিপোর্ট পেলে সম্পন্ন করে ফেলব।
তিনি আরও বলেন, জেলা নির্বাচন অফিসে টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে সবাই দিন-রাত পরিশ্রম করেছে। যার ফলস্বরূপ সব আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
গত বছর ডিসেম্বরে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক এএসএম হুমায়ুন কবীর মাঠ কর্মকর্তাদের ৩০ জুনের মধ্যে সকল অনিষ্পন্ন অবস্থায় থাকা এনআইডি সংশোধনের আবেদন নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেসময় তিনি বলেন, ‘এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। একদিকে আবেদন নিষ্পত্তি করা হবে, অন্যদিকে নতুন আবেদনও পড়বে। আমরা চেষ্টা করছি, যেন কোনো আবেদন ঝুলে না থাকে।’ সে নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা।
নাগরিকদের নির্ভুল ও নিরাপদ জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো জীবন-যাপন সহজ করা। এর পরিবর্তে, এই এনআইডি পাওয়া হয়ে উঠেছিল মাথাব্যথার কারণ। বানান ভুল থেকে শুরু করে হাস্যকর জন্মতারিখ, ভুল পারিবারিক সম্পর্কসহ আরও নানা ভুল এখন এতটাই স্বাভাবিক যে এগুলো হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে যার এনআইডিতে ভুল থাকে, তাদের জন্য কিন্তু বিষয়টি মোটেও হাস্যকর নয়। দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা-জেলা, আঞ্চলিক, এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে পর্যন্ত ঢুঁ মারতে হতো নাগরিকদের। তবে ক্র্যাশ প্রোগ্রামের ফলে অবসান হলো নাগরিকদের কষ্ট।