বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর আওতায় ৩৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন বাতিল করতে যাচ্ছে সরকার, যার ৩৪টিতে সৌরশক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ছিল, বাকি পাঁচটি ছিল গ্যাসভিত্তিক। যে আইনের সুযোগে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল সেই আইনটিও বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে বলে অন্তর্র্বতী সরকারের তরফে জানানো হয়েছে। এ আইনের দুটি ধারা ইতোমধ্যে আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে।
৩৪টি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৬৭৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার পরিকল্পনা ছিল; যার পেছনে ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে বলে হিসাব করা হচ্ছিল। বাকি ৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসভিত্তিক, সেগুলোর মোট উৎপাদনক্ষমতা কত, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং অন্তর্র্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর সব ধরনের সরকারি প্রকল্প প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এর অংশ হিসাবে চুক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে প্রতিযোগিতামূলক দামের অধীনে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খবর বিডিনিউজ’র
এরই মধ্যে লেটার অব ইনটেন্ড বা এলওআই সনদ পাওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রক্রিয়া বাতিলের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তবে সরকারের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাচ্ছে এলওআই পাওয়া কোম্পানিগুলো। এরই মধ্যে ১১টি রিট আবেদন জমা পড়ার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পেরেছে।
রিট আবেদন করা একটি কোম্পানির আইনজীবী বলেছেন, তারা মনে করেন, এরই মধ্যে যেসব চুক্তি হয়ে গেছে, সেগুলো বাতিল করা উচিত হবে না। এর কারণ, কোম্পানিগুলো প্রাথমিক অনুমোদনপত্র পাওয়ার পর এরই মধ্যে বেশ কিছু খরচ করে ফেলেছে। আর এভাবে প্রকল্প বাতিল করলে ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়া কঠিন হবে।
গত ১৮ নভেম্বর কোরিয়ার দিহান গ্রিন এনার্জি ও বাংলাদেশের পাবনা সোলার পাওয়ার লিমিটেডের একটি কনসোর্টিয়ামের কাছে পাঠানো একটি চিঠির ব্যাপারে জানা গেছে।
সেখানে বলা হয়েছে, কোম্পানির অনুকূলে ইস্যু করা এলওআই সশ্লিষ্ট কার্যক্রম উপরোক্ত [বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০] আইনের পরিবর্তে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র পদ্ধতিতে পক্রিয়াকরণের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।
এলওআই বাতিলের কথা জানিয়ে আরও অন্তত ১১টি কোম্পানিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে : জুলস পাওয়ারের কক্সবাজার ৫০ মেগাওয়াট সোলার প্রজেক্ট, রিনিউয়েবল এনার্জি ইউকে, বাদল কনস্ট্রাকশন ও জি-টেক সলুশনের বাসাইল টাঙ্গাইল ১০০ মেগাওয়াট সোলার প্রজেক্ট, চায়না ডেটং ওভারসিজ ইনভেস্টমেন্ট ও এনগ্রিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গোয়ালন্দ, রাজবাড়ির ১০০ মেগাওয়াট সোলার প্রজেক্ট, হংকংয়ের জেটি নিউ এনার্জি কোম্পানির চকরিয়া ২২০ মেগাওয়াট উইন্ড পাওয়ার প্রজেক্ট।
সাতক্ষীরায় সাসটেইনেবল এনার্জি ইন্টারন্যাশনালের ১০০ মেগাওয়াট উইন্ড প্রজেক্ট, ময়মনসিংহে ক্যাসিওপিয়া ফ্যাশন, শিজি ক্লিন এনার্জি ইক্যুইপমেন্ট ও ক্যাসিওপিয়া এপারেলসের ১০০ মেগাওয়াট সোলার প্রজেক্ট, নীলফামারীতে এএসকে নিওএনার্জি, এজে পাওয়ার ও এটিএন সল্যুশনের যৌথ কনসোর্টিয়ামের ৫০ মেগাওয়াট সোলার প্রজেক্ট, দিনাজপুরে গ্রিন প্রোগ্রেস রিনিওয়েবল ও আইআরবি অ্যাসোসিয়েটসের কনসোর্টিয়ামে ১০০ মেগাওয়াট সোলার প্রজেক্টও বাতিল হতে যাচ্ছে।
আরও আছে ময়মনসিংহের ত্রিশালে এনার্গন রিনিউয়েবলস ও পিডব্লিউআর অ্যাসোসিয়েটসের ২৪০ মেগাওয়াট সোলার প্রজেক্ট, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় একই কোম্পানির ১৩০ মেগাওয়াট সোলার প্রজেক্ট এবং খুলনার রূপসায় একই কোম্পানির ১০০ মেগাওয়াট সোলার প্রজেক্ট।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আইপিপি ইউনিটের প্রধান প্রকৌশলী এ বি এম জিয়াউল হক বলেন, “চিঠি দেওয়ার আগে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরাসারি কথা বলেছেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টাসহ পিবিডির শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। চিঠিতে প্রকল্প বাতিলের কথা সরাসরি বলা হয়নি। তবে বর্তমান সরকার প্রতিযোগিতাহীন প্রক্রিয়ায় নেওয়া এসব উদ্যোগ থেকে সরে আসবে বলেই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন বাকি কাজগুলো আলোচনা সাপেক্ষে এগোবে।”
এলওআই বাতিলের বিষয়ে চিঠি পেয়ে বেশ কয়েকটি কোম্পানি পিডিবিকে পাল্টা উকিল নোটিস পাঠিয়েছে। আদালতেও যাচ্ছে তারা। এমনই একটি কোম্পানি হচ্ছে কক্সবাজারে ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য এলওআই সনদ দেওয়া জুলস পাওয়ার লিমিটেড।
এই কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ১৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছি। প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছিল। এর মধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত এল।”
কোম্পানির আইনজীবী আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান রুম্মন বলেন, “সরকার মনে করলে ২০১০ সালের একটা আইন আর প্রয়োগ নাও করতে পারে। কিন্তু সেই আইনের অধীনে যে চুক্তিগুলো হয়ে গেছে, সেগুলো বাতিল করাটা সরকারের ক্ষমতার বাইরে।
“সরকার নীতি সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা ভবিষ্যতে প্রয়োগের পথে না হেঁটে অতীতে প্রয়োগের পথে হাঁটছে। ২০১০ সালের ওই আইনের দুটি ধারা বাতিল করে হাই কোর্টের একটা রায়ের আলোকে সরকার এমন উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু রায়ের লিখিত কপি এখনও প্রকাশই হয়নি।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, “অতিরিক্ত ব্যয় কমাতে এবং প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি চালু করতে সরকার এমন উদ্যোগ নিয়েছে। যাদের চুক্তি বাতিল করা হচ্ছে তারা চাইলে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রকল্প সচল রাখতে পারেন। তবে সরকারের সিদ্ধান্ত হচ্ছে এখন উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়া এই ধরনের প্রকল্প আর হাতে নেওয়া হবে না।”