এস কে লিটন কুতুবী, কুতুবদিয়া
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বায়ুকল (উইন্ড টারবাইন) স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে দুই দফায় ৩৮ কোটি টাকা খরচ দেখালে তা আলোর মুখ দেখেনি দীর্ঘ ১৭ বছরেও। বিদ্যুৎসুবিধা বঞ্চিত এলাকায় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় জাতীয় গ্রিড লাইনের বিকল্প হিসেবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় উইন্ড টারবাইন স্থাপন করার জন্য। ২০০৮ সনে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের আত্মীয় প্রকৌশলী ফজলুল রহমান নামের এক ব্যক্তিকে দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এ কাজ শুরু করে। তবে আজ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারেনি এ প্রকল্প।
পিডিবির অফিস সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার মানুষকে বিদ্যুসুবিধা দিতে দুটি প্রকল্পের অধীন ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র। একটি প্রকল্প ২০০৮ সালে ও অপরটি ২০১৬ সালে চালু হয়। দুই প্রকল্পের অধীন বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য স্থাপন করা হয় ৭০টি বায়ুকল। প্রথম প্রকল্পের অধীন স্থাপন করা বায়ুকল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় মাত্র কয়েক দিন। দ্বিতীয় দফায় চালু করা বায়ুকল সক্রিয় ছিল কয়েক মাস। এরপর থেকেই বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের বায়ুকলগুলো কেবল দর্শণার্থীদের উপভোগের স্থান পেয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের পুরো টাকাই প্রকৃতপক্ষে কিছু কাজ দেখিয়ে বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প : কোষাগারের মূল্যবান টাকা খরচ করে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হলেও জাতীয় তথ্য বাতায়নে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকাটিকে দর্শনীয় স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের তাবলেরচর এলাকার পশ্চিম সৈকতে ২০০৮ সালে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় এক হাজার কিলোওয়াট (এক মেগাওয়াট) উৎপাদন ক্ষমতার বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কেন্দ্রের দুই পাশে খোলা জায়গায় স্থাপন করা হয় ৫০ ফুট উঁচু ৫০টি বায়ুকল। মাথায় লাগানো হয় ফাইবারের উইন্ড টারবাইন বা বায়ুচালিত পাখা। বাতাসে পাখা ঘুরলে উৎপাদিত হয় বিদ্যুৎ। সেই বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে জমা করে গ্রাহকের কাছে সরবরাহের কথা।
২০০৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। এরপর ২০০৯ সনের ১৪ এপ্রিল ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে সান্ধ্যকালীন কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় কেন্দ্রের একটি যন্ত্র অচল হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে থাকা বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে কেন্দ্রটি ঝুঁকির মুখে পড়ে। দীর্ঘ ১৭ বছরে কেন্দ্রটি আর আলোর মুখ দেখেনি। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তাঁর ঐ আত্মীয় প্রকৌশলী ফজলুল হককে দিয়ে ২০১৬ সালে অচল হয়ে পড়া বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে এক মেগাওয়াটের আরেকটি নতুন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। তাতে খরচ হয় ২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ কেন্দ্রটি চালু হয়। তখন ৩৫০ জন গ্রাহকের কাছে সন্ধ্যাকালীন কয়েক ঘণ্টার বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছিল। কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই এটিও অচল হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় প্রকল্পটিও এ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বাসিন্দারা বলেন, দুর্নীতি-লুটপাটের জন্যই নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করে দুর্গম উপকূলে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এ জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে। বর্তমানে কেন্দ্র দুটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে সকল মালামাল।
বিগত দুই বছর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবো কর্তৃপক্ষ শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেড়িবাঁধের বিভিন্ন অংশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও স্বাভাবিক জোয়ারে ভেঙে গেছে। বাঁধের পাশে পড়ে আছে দোতলা একটি ভবন, যার ভেতরে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যালয়, উৎপাদিত বিদ্যুৎ ধারণের এক হাজার ব্যাটারি ও মূল্যবান যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়। ভবনের দুই পাশে (উত্তর-দক্ষিণ) খোলা জায়গায় স্থাপিত ৫০টি বায়ুকলে মরিচা ধরেছে। খুঁটির মাথায় বাঁধা ফাইবারের উইন্ড টারবাইনগুলো ভেঙে পড়েছে। অধিকাংশ খুঁটি হেলে পড়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্যাবল (তার) নেই। পরিত্যক্ত দোতলা ভবনের ভেতরে তেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ভবনের ভেতরে থাকা ব্যাটারি, মূল্যবান যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, কুতুবদিয়া উপকূলে স্থাপিত বায়ুকল দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উৎপাদনে সফল হতে না পারায় কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করতে পারেনি। বর্তমানে এ প্রকল্পটি পিডিবির গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।