ম. শামসুল ইসলাম
ঘনকালো অন্ধকার সেই রাতটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিহরে উঠে। যে রাতটি চোখের পলকে কেড়ে নিয়েছে অনেক স্বজনকে। মৃত্যুতে খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম সেই রাতটিতে। রাতভর পানিতে ভেসেও আল্লাহ তায়ালার অপার মহিমায় অলৌকিকভাবে ফিরে এসেছিলাম মৃত্যুর মুখ থেকে।
বলছিলাম এখন থেকে ৩৪ বছর আগের দুঃসহ সেই স্মৃতির কথা। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার সহ দেশের উপক‚লীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৯৯১ সালের উনত্রিশে এপ্রিলের সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের রাতের কথা। এই ২৯ এপ্রিল অনেকের কাছে কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় লেখা একটি তারিখ; কিন্তু আমার জীবনে এই তারিখটি ছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ। তখন তো ছেড়েই দিয়েছিলাম জীবনের আশা। কিন্তু বেঁচে গিয়েছিলাম ডালপালাহীন একটি গাছকে অবলম্বন হিসেবে পেয়ে। এরপর এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে কেটে গেল আরো ৩৪টি বছর। কিন্তু এখনো ভুলতে পারিনা বিভীষিকাময় সেই রাতের কথা।
আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। থাকতাম শহরের সদরঘাট এলাকায় বড় ভাইয়ের সাথে। ঘূর্ণিঝড়ের আগের দিন রোববার গিয়েছিলাম বাড়িতে। বঙ্গোপসগার আর শঙ্খ নদী তীরর্বুী আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর গ্রামেই গ্রামেই আমাদের বাড়ি। বাড়ি থেকে মাত্র আধ কিলোমিটার পশ্চিমেই বঙ্গোপসাগর। আর শঙ্খ নদীর অবস্থান আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণে। শৈশব থেকেই সাগরের ঢেউ, বেড়িবাঁধের ভাঙ্গন, ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত আমাদের মতো উপকূলীয় এলাকার লোকজনের কাছে অতি পরিচিত। আর সেই অতি পরিচিতিই উপক‚লবাসীর জন্য কাল হয়ে এসেছিল সেই রাতে।
বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সংকেত মিলেছিল আগের দিনই। কিন্তু সেই ঘূর্ণিঝড় এণটা ভয়াল রূপ নেবে তা ছিল উপক‚লবাসীর ধারণার বাইরে। আগেরদিনের আবহাওয়া অন্যদের মতো আমার কাছেও মনে হয়েছিল একেবারে স্বাভাবিক। কিন্তু ২৯ এপ্রিল সকাল থেকে আবহাওয়ার কিছুটা পরির্বুন দেখা যায়। আকাশে ভারি মেঘের আনাগোনা ছিল এদিন সকাল থেকেই। হালকা বাতাসের সঙ্গে ছিল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আর সেই অবস্থা ক্রমশ বদলাতে থাকে দুপুরের পর থেকে। ক্রমশ বাড়তে থাকে বাতাসের গতি। সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় দমকা হাওয়ার সাথে ঝড়-বৃষ্টি। আমাদের ঘরটি ছিল মাটির দেয়ালে ঘেরা আর উপরে টিনশেড দেওয়া। আমি, মা ও আমার ভাগিনী বিলকিস। দমকা হাওয়ার ঝাপটায় টিনের চালার পেরেক ক্রমশ যে নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছিল তা চালার শব্দ শুনেই বুঝতে পারছিলাম। এ অবস্থার মধ্যেই আম্মা রান্না শেষ করে ফেলেন। কিন্তু খাওয়া হয়নি কারো।
রাত ৯টার দিকে জেঠাত ভাই আবুল কালাম বৃষ্টির মধ্যে এসে আম্মাকে জানালেন ১০নম্বর বিপদ সংকেতের কথা। বললেন, সাইক্লোন শেল্টার কিংবা দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু আম্মা রাজি হলেন না। বললেন- বিল খাল শুকনো। কত আর পানি হবে। পানি আসলে তা তো জমি চুষে নেবে। বিপদ থেকে বাঁচতে বাড়ির অনেকেই এসময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও আমরা রয়ে গেলাম ঘরে। আমাদের পাশাপাশি বাড়ির আরো কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা সাইক্লোন শেল্টারে না গিয়ে রয়ে গেলেন নিজ নিজ ঘরে। বাইরে প্রচন্ড গতিতে বইছিল ঝড়। টিনের চালা হওয়ার কারণে ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিলনা তখন। মনে মনে ভয় লাগলেও ভরসা দিচ্ছিলেন আম্মা। হারিকেন জ্বালিয়ে একটি রুমে এসে বসে সবাই মিলে দোয়া দরুদ পড়ছিলাম। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল দমকা হাওয়া আমাদের ঘরটিই হয়ত উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তারপরও কোনভাবে রাতটা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
তখনো আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। বাতাসের কারণে হারিকেনও জ্বালিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। তাই অন্ধকারে একমাত্র সম্বল ছিল ব্যাটারি চালিত টর্চলাইটটি। রাত বারোটার দিকে জানালার দরজা খুলে বাইরে টর্চ লাইটের আলো ফেলতেই দেখি ঘরের দেয়ালের কাছেই পানি। আম্মাকে বলার পর তড়িঘড়ি করে আম্মা আর ভাগিনীসহ বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। আমার ডাকাডাকিতে ৫বছরের পুত্র বাদশা আর ৩বছরের মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলো জেঠাত ভাই ফয়েজ ও তাঁর স্ত্রী। এলেন জেঠাত বোন আয়েশা, তাঁর স্বামী সত্তরোর্ধ আছদ আলী ও মেয়ে ফাতেমা। বাড়ির উঠোনে তখন কোমর সমান পানি। সবাই মিলে পানি ভেঙ্গে ভিটের উত্তর পূর্ব পাশে থাকা খড়ের গাদায় গিয়ে উঠলাম।
প্রথম দফায় শংখ নদী থেকে থেকে ধেয়ে আসা পানি দ্রুত বাড়ছিল তখন। এ অবস্থায় আমরা একে অপরকে ধরে সেই খড়ের গাদায় একসঙ্গে জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলাম । কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারিনি। আধ ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ১২টায় বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে ছিড়ে যায় খড়ের গাদাটি। আমার চোখের সামনেই অল্প খড় সহ বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে গেলেন আম্মা ও ভাগিনী। খড় ধরে তাঁদের টেনে রাখার কোন চেষ্টাই কাজে আসল না। একইভাবে একে একে ভেসে গেলেন আয়েশা ও তাঁর স্বামী আছদ আলী। ছেলে বাদশা আর মেয়ে মুন্নীকে কাঁধে নিয়ে খড় ধরে ভেসে গেলেন জেঠাত ভাই ফয়েজ। অথৈ সাগর মাঝে গাছের ঢাল আর খড়ে গাদা সঙ্গী করে তখনও সেখানে রইলাম আমি, ফয়েজের স্ত্রী চেমনারা ও জেঠাতো বোনের মেয়ে ফাতেমা। হঠাৎ করে দেখলাম দক্ষিণ দিক থেকে একটি খালি চালা ভেসে এসে ঠেকল খড়ের গাদা ও পার্শ্বর্বুী ফুল গাছের সঙ্গে। আমরা তিনজন কোনভাবে উঠে পড়লাম সেই চালায়। দশ মিনিটের মতো ওই চালার ওপর বসেছিলাম। এরপর হঠাৎ বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসের প্রচন্ড স্রোতে চালাসহ আমরা ভেসে যেতে লাগলাম পূর্ব দিকে। ভাসতে ভাসতে কিছুদূর যাবার পর ঢেউয়ের তোড়ে চালা থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম আমি। হাবুডুবু খেতে লাগলাম অথৈ পানিতে। বেঁচে থাকার আসা ছেড়ে দিলাম। অনেকটা মেনে নিলাম হয়ত জীবন প্রদীপটা ওখানেই নিভে যাচ্ছে।
পানিতে ভাসতে ভাসতেই হঠাৎ সামনে পেলাম ঝড়ে ডাল পালা ভেঙ্গে গিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকা একটা কড়ই গাছ। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম গাছটি। প্রচন্ড বেগে ছুটে আসা এক একটি ঢেউ চলে যাচ্ছিল মাথার উপর দিয়ে। গাছটি জড়িয়ে ধরে ঢেউয়ের ধাক্কার মুখে অনেক কষ্টে নিজেকে টিকিয়ে রাখছিলাম। একটা ঢেউ যাবার পর মাথাটা কোনভাবে পানির উপরে তুলে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। গাছটির ডালপালা না থাকায় উপরে উঠারও কোন সুযোগ ছিলনা।
রাত তখন অনেক গভীর। গাঢ় অন্ধকারেও বুঝতে পারছিলাম পানির নিচে ডুবে গেছে পুরো এলাকা। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। মনে হচ্ছিল যেন সাগর মাঝে ভাসছি আমি। ঘরের চালা, গাছ পালা, খড় কুটো ইত্যাদি স্রোতের সাথে ভেসে যাচ্ছিল আমার কাছ দিয়েই। পানিতে ভাসতে থাকা এক নারীকে দেখলাম গোঙাতে গোঙাতে এসে ঠেকেছে একটু দূরে আরেকটি গাছের সঙ্গে। কিন্তু এ সময় গাছটি ধরে বাঁচার চেষ্টা করার মু শক্তিও তার ছিল না। কিছুক্ষণ পরে সেখানেই তাকে নিথর হয়ে ভাসতে দেখলাম। এভাবে অনেক আদম সন্তানের লাশ ভেসে যেতে দেখেছি খুব কাছে থেকে। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে পাওয়া সেই গাছটি বুকে নিয়ে ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের সাথে যুদ্ধ করেই কেটে যায় সারারাত।
রাত অনুমান তিনটার পর থেকে পনি কমতে শুরু করে। পানি কমে যাওয়ার পর সকাল ৭টার সময় নেমে আসি গাছের ওপর থেকে। নিচে তখনো বুক সমান পানি। পানি সাতরে অনেক কষ্টে কোনভাবে উঠে এলাম বাড়ির সামনের রাস্তায়। এ সময় রাস্তার দু’পাশে দেখা যাচ্ছিল কেবল লাশ আর লাশ। চিৎ, কাত, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বিবস্ত্র নারী পুরুষের লাশ, সন্তান বুকে মায়ের লাশ, গরু-ছাগলের অসংখ্য মরদেহ। চোখের সামনে ভেসে যাওয়া আম্মা-ভাগিনী, প্রতিবেশি কারো বেঁচে থাকার আশাই করতে পারছিলাম না তখন। ভিটেতে ফিরে দেখি ঘরের কোন অস্তিত্ব নেই। আর সেই শ‚ন্য ভিটেয় ভেজা কাপড়ে বসে কাঁদছেন আম্মা। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন বুকে। জানালেন, খড়সহ ভেসে যাবার সময় সামনে পাওয়া একটি গাছ ধরে রাতভর পনির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন তিনিও। একইভাবে কিছু দ‚রে বাঁশের ঝোঁপে আটকে পড়ে বেঁচে যান ভাগিনী বিলকিসও। কিন্তু চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় জেঠাত ভাই ফয়েজ, তার ছেলে বাদশা ও মেয়ে সহ আমাদের বাড়ির তিনটি পরিবারের ১৬জন সদস্য। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মিলেনি এদের অনেকের লাশের সন্ধান।
শৈশব থেকে এ পর্যন্ত জীবনে আনন্দ-বেদনার অনেক স্মৃতি তৈরি হয়েছে। অনেক স্মৃতি ভুলে গেছি কিংবা ইচ্ছে করে ভুলে থাকি। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারিনা ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের সেই ভয়াল রাতটির কথা। এখন ভাবি, সেই রাতটিই তো হতে পারতো জীবনের শেষ রাত। ওই রাতের চৌত্রিশটি বছর পরেও যে এই সুন্দর পৃথিবীর আলো বাতাস গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছি- এটা তো আমার বোনাস লাইফ। এজন্যে কৃতজ্ঞতা শুধু রাহমানুররাহিমের কাছে।
লেখক :সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক দেশ রূপান্তর, চট্টগ্রাম ব্যুরো