২৮ লাখ টাকার লিফট উধাও বিটুমিনে বকেয়া প্রায় ৩ কোটি

12

মনিরুল ইসলাম মুন্না

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) জন্য ২৮ লাখ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল দুইটি লিফট। কিন্তু সেগুলো প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার হয়নি। অপরদিকে কদমতলীর বর্ণালি অয়েল নামে একটি দোকানে বাকিতে বিক্রি করা বিটুমিনের দুই কোটি ৮৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা উদ্ধার হয়নি ৩ বছরেও। অর্থাৎ, টাকাগুলো ফেরত পায়নি কোম্পানি। এ দুই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটি মামলা দায়ের করেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। তবে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর কর্মকর্তাদের দায়সারা মনোভাবে প্রায় ডুবতে বসা সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। গত বৃহস্পতিবার এসএওসিএল ও বিপিসি কার্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পূর্বের কর্মকর্তাদের আত্মসাৎ করা টাকাগুলো ফেরত পাওয়া গেলে এ প্রতিষ্ঠানটি আরও গতিশীল হবে। ঘাটতিতে থাকার পর তিন বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠানটি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিপিসি দায়িত্ব নেয়ার সময় কোম্পানিতে পুঁজি ছিল মাত্র ৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। বর্তমানে তা ১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
এসএওপিএল বিপিসি’র হাতে আসার পর প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব দেওয়া হয় বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মনি লাল দাশকে। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘এসএওসিএল অর্থ কষ্টে থাকা সত্ত্বেও সংস্থাটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রথম অবস্থায় ছিল না কোনো ব্যবসা, কোনো ক্রেতা বা কাঁচামাল। অল্প অল্প করে লুব অয়েল আমদানি করে বিক্রি শুরু করি। ধীরে ধীরে পুঁজি বাড়তে শুরু করল। বাড়লো কাজের পরিধিও। শুরু করি মার্কেটিং, বিক্রি শুরু করি ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল। ২০২১ সালে যেখানে অর্থের অভাবে ১০৯ জন শ্রমিক ছাটাই করেছি, এক বছরের ব্যবধানে আবার ১২৭ জন শ্রমিক নিয়োগ দিই। এরই মধ্যে আমরা কয়েকটি বার্ষিক সাধারণ সভা আদালতের অনুমতি নিয়ে সম্পন্ন করেছি। বাকিগুলোও আদালতের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছি। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের ১১৫ কোটি টাকার মত পাওনা আছি। সেখান থেকে বিপিসি ৮০ কোটি টাকা পাবে। তা বাদ গেলে ৩৫ কোটি টাকা আমাদের থাকবে। বর্তমানে পুঁজি ১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গড়ে প্রায় ৩৬ হাজার লিটার ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া লুব্রিকেন্টস অয়েল এবং গ্রিজ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। আমাদের বড় গ্রাহকের মধ্যে একটা হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। পাশাপাশি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের কাছ থেকে ডিজেল, গ্রিজ এবং ফার্নেস অয়েল নিচ্ছে নিয়মিত।’
পূর্বের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও আনুষাঙ্গিক খরচ বাবদ মাসে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মতো লাগে। লুট হওয়া টাকাগুলো ফেরত আনার জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। মামলা চলমান আছে। এসব টাকা আনতে পারলে সংস্থাটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।’

সরকারের কেনা ২৮ লাখ টাকার লিফট পাঁচ বছর ধরে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অডিট অধিদপ্তরের অডিট আপত্তি সূত্রে জানা গেছে, এসএওসিএল’র ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে ৪১ লাখ ৭২ হাজার ৪০০ টাকা মূল্যের লিফটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট এসএওসিএলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় বিপিসি।
অডিট আপত্তির সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি লিফট প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে স্থাপন করা হয়। অন্য দুটি লিফটের বিষয়ে জানতে বন্দর থেকে খালাসকারী সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান ‘হট-লাইন কার্গো ইন্টারন্যাশনাল’ ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি এজেন্ট ‘ও-২ এলিভেটরস কো. লিমিটেড’কে ২০২১ সালের ৮ জুন চিঠি দেয় এসএওসিএল। হটলাইন কার্গো ইন্টারন্যাশনাল এসএওসিএলের চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি। তবে চিঠির জবাব দেয় ‘ও-২ এলিভেটরস কো. লিমিটেড’। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজে লিফট দুটি স্থাপন করা হয়েছে। ৬৩০ কেজি ভারবহন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ও এক হাজার কেজি ভারবহন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি লিফট আমদানির জন্য ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর যমুনা ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় ঋণপত্র (নম্বর-৩০৩৮১৮০১০৩০৭) খোলে এসএওসিএল। এর মধ্যে এক হাজার কেজির দুটি লিফট স্থাপন করা হয়েছে ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজে। লিফট দুটির এলসি মূল্য ৩৩ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার। ওই সময় প্রতি ডলার ৮৩ টাকা ৯৫ পয়সা হিসেবে লিফট দুটির মূল্য ২৮ লাখ টাকার কিছু বেশি, যা লোপাট হয়েছে বলে অডিটরদের ধারণার সত্যতা মিলেছে।
বিপিসি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হটলাইনে আসা এক অভিযোগের সূত্র ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় অভিযান চালিয়ে এসএওসিএলের পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদ ও তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদের বিরুদ্ধে ৫৭ কোটি টাকা অবৈধভাবে স্থানান্তরের প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর নড়েচড়ে বসে বিপিসি। ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এসএওসিএলের ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়-ব্যয় ও অডিটসহ সার্বিক আর্থিক কর্মকান্ড পর্যালোচনার জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিপিসি। বিপিসির তদন্ত কমিটি ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের নমুনাভিত্তিক কিছু আর্থিক কার্যক্রমের অনুসন্ধান করে প্রায় তিনশ কোটি টাকা অনিয়মের সত্যতা পায়। এরপর বিপিসি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দুদকে পাঠায়।
বিপিসির তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ২০২১ সালের ৯ মার্চ প্রায় ৮১ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এর আগে ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. শাহেদকে আসামি করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে, মহাব্যবস্থাপক মো. শাহেদ মারা যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় বিপিসি। এরপর বেরিয়ে আসতে থাকে ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এসএওসিএলে ঘটে যাওয়া নানা অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র। মূলত ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজের মালিক ও অধ্যক্ষ ছিলেন প্রয়াত মহাব্যবস্থাপক শাহেদের বাবা ইঞ্জিনিয়ার বাকী। ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজটি পশ্চিম খুলশী থাকলেও ২০১৭ সালে নিজেদের মালিকানাধীন ৯ তলার ভবনে চলে আসে। ওই নতুন ভবনেই লাগানো হয় লিফট দুটি। পরে শাহেদ মারা যাওয়ার ১৫ দিনের মাথায় তার বাবাও মারা যান। এরপর প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হন শাহেদের আরেক ভাই ইঞ্জিনিয়ার এবিএম আবদুল ওয়াহেদ। তিনি ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বও নেন। ওই ভবনে তাদের মালিকানাধীন চিটাগাং ন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামের আলাদা আরেকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে চারটি বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয়।
তিন বছর ৪ মাস পার হলেও আদায় হয়নি বিটুমিন বিক্রির ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা : প্রয়াত মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ (জিএম শাহেদ) দায়িত্বে থাকাকালীন এসএওসিএলের আমদানি করা বিটুমিন বিক্রির জন্য একমাত্র ডিলার ছিল চট্টগ্রাম মহানগরীর কদমতলী এলাকার মেসার্স বর্ণালী নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির মালিক শুভাশীষ বোস ওরফে মিঠু বাবুর সঙ্গে জিএম শাহেদের সখ্য ছিল। তিনি মারা যাওয়ার দিন পত্রিকায় শোকবার্তা দিয়ে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন শুভাশীষ বোস ওরফে মিঠু। ২ কোটি ৮৭ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা পাওনা পরিশোধের জন্য ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি শুভাশীষকে চিঠি দেয় এসএওসিএল। ওই চিঠি সূত্রে জানা যায়, জিএম শাহেদ মারা যাওয়ার পর ৬০-৭০ গ্রেডের ৩৯৯৬ ড্রাম বিটুমিন বিক্রি করে এ পর্যন্ত এসএওসিএলকে মূল্য পরিশোধ করেননি শুভাশীষ বোস মিঠু। বিপিসি ও এসএওসিএলের তৎকালীন ডিজিএম মুহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন আজাদের সই করা ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৬০-৭০ গ্রেডের বিপিসি নির্ধারিত দামে প্রতি ড্রাম ৭ হাজার ২০০ টাকা হারে মোট ২ কোটি ৮৭ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আবশ্যিকভাবে এসএওসিএলের হিসাবে জমা দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।’ ওই চিঠির পরে বেশ কয়েকবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও ওই অর্থ পরিশোধ করেননি শুভাশীষ। এরপর মামলার সিদ্ধান্ত নেয় এসএওসিএল পর্ষদ।
২০২১ সালের ৪ নভেম্বর এসএওসিএলের ৪১২তম পর্ষদ সভায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় আদালতে মামলার সিদ্ধান্ত হয় এবং পরবর্তীতে মামলা করেন এসএওসিএল। বর্তমানে মামলাগুলো চলমান রয়েছে।