এম কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি
বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। অন্যদিকে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়কের অভাবে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই জেলা সদরের সাথে দেশের বৃহৎ ২ উপজেলা লংগদু ও বাঘাইছড়ির। সড়ক না থাকায় শুধু জনদুর্ভোগই নয়, পিছিয়ে পড়ছে পর্যটন ও অর্থনীতি। দীর্ঘ অপেক্ষা, সীমাহীন দুর্ভোগ আর পিছিয়ে পড়ার গল্পই যেন এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। অথচ নানিয়ারচরের বড়পোল হতে মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মিত হলেই বদলে যেতে পারে এই সব কষ্টগাঁথা বেদনা। বদলে যেত এই অঞ্চলের চিত্র।
একটি সড়ক, যা বদলে দিতে পারে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির সম্ভাবনা। দুর্গম পাহাড়ের বুক চিড়ে যে সড়ক নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের সেই সড়ক শুধু পাথর আর বিটুমিনের নয়, এটি লক্ষ মানুষের স্বপ্ন, সম্ভাবনা আর উন্নয়নের প্রতীক হিসাবে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এখনো অপেক্ষমান। বহু বছর ধরে এ সড়ক নিয়ে আলোচনা হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানিয়েছে, এ সড়ক বাস্তবায়নের গুরুত্ব তুলে ধরে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
দেশের প্রতন্ত অঞ্চলগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছে গেলেও আজও লংগদু এবং বাঘাইছড়ির মানুষকে জেলা সদরে যেতে হয় নৌপথে। শুষ্ক মৌসুমে হ্রদের পানি শুকিয়ে গেলে দুর্ভোগে পড়ে ৫ লক্ষাধিক মানুষ। যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য নষ্ট হয় জমিতেই। মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়কের অভাবে লংগদু থেকে নানিয়ারচর আসতে সময় লেগে যায় ৫-৬ ঘণ্টা। বর্তমানে নৌ-পথে রাঙামাটি থেকে লংগদু যেতে ৫-৬ ঘণ্টা এবং বাঘাইছড়ি যেতে সাত-আট ঘণ্টা সময় লাগে যায়। তবে সড়ক হলে এই দূরত্ব কমে আসবে মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টায়। সড়ক না থাকায় উচ্চশিক্ষা বঞ্চিত হচ্ছে এক প্রজন্ম, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ঝরছে প্রাণ, বাজারজাতের অভাবে কৃষকের ঘামঝরা ফসলের উঠছে না মূল্য। অথচ এত অল্প দূরত্বের একটি সড়ক হলেই বদলে যেত এই পাহাড়ি জনপদের দৃশ্যপট।
এই সংযোগ সড়ক শুধু যোগাযোগ সহজ করবে না, এটি পাহাড়ের অর্থনীতিকে করবে চাঙা, খুলবে পর্যটনের নতুন দুয়ার। সাজেক ভ্যালির মতো জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রের সঙে লংগদু-রাঙামাটি বান্দরবান হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত সরাসরি সড়ক যোগাযোগ তৈরি হবে, যা পার্বত্য জেলা রাঙামাটিকে পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করবে। গড়ে উঠবে নতুন পর্যটন স্পট, বাড়বে কর্মসংস্থান, সমৃদ্ধ হবে স্থানীয় অর্থনীতি একাই এই সড়কই হয়ে উঠবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি।
স¤প্রতি সরেজমিনে নানিয়ারচরের বড়পুল পাড়ায় পরিদর্শনে গেলে স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্টদের কন্ঠস্বরে ফুটে উঠে এই অঞ্চলের এসব কষ্টগাঁথা ও সম্ভাবনার চিত্র। গ্রামটির বাসিন্দা পলেন চাকমা ও সুধাকর চাকমা বলেন, নানিয়ারচর থেকে লংগদু সড়কটি নির্মাণ হলে লংগদু, বাঘাইছড়ির মানুষদের খাগড়াছড়ির দীঘিনালা হয়ে ঘুরে রাঙামাটি যাওয়া লাগবে না। তখন তারা দ্রুত রাঙামাটি যাতায়াত করতে পারবে। যাতায়াতে এখন তিন দিন লাগলেও সড়ক হলে লাগবে সর্বোচ্চ দুই-তিন ঘণ্টা। এ সড়কটিতে প্রয়োজনীয় সব কয়টি সেতুই আছে। এখন দরকার সড়ক নির্মাণ। সড়ক হলে লংগদু থেকে নানিয়ারচরে যাতায়াতে সবকিছুতেই সুবিধা হবে। গ্রামবাসী কৃষিপণ্য খুব সহজে বাজারে নিতে পারবে। দামও ভালো পাবে।
একই এলাকার বাসিন্দা পলাশ চাকমা ও পূর্ণিমা চাকমা বলেন, আমাদের এদিকে আনারস, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফল ও সবজির চাষ হয়। এই রান্তাটি হলে আমাদের মালামাল পরিবহনে সময় ও খরচ দুই-তৃতীয়ংশই বেঁচে যাবে। তাছাড়া রাস্তাটি ভালো হলে সবারই সুবিধা হতো। এখন যাতায়াতে বেশি কষ্ট। অন্তঃসত্ত্বা নারী ও জরুরি রোগীর যাতায়াতে খুবই অসুবিধা হয়। বর্ষাকালে তো পা ফেলাই যায় না।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য মিনহাজ মুরশীদ বলেন, প্রস্তাবিত এ সড়কটি পাহাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। বর্তমান সময়ে তো কল্পনাই করা যায় না যে একটা জেলা সদরের সাথে উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই দুর্বল ও করুণ। নানিয়ারচরের বড়পুল থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলে লংগদু হবে কৃষিপণ্য বিপণন ও পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ হ্যাব। এতে বছরে বাণিজ্য হবে কয়েক হাজার কোটি টাকার। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্যও কাজে আসবে। পাহাড়ে উচ্চ-শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে।
পর্যটকরাও সাজেক থেকে লংগদু-রাঙামাটি-বান্দরবান হয়ে স্বল্প সময় ও খরচে কক্সবাজার যেতে পারবেন। একটি সড়কের অভাবে যে অঞ্চল এত বছর পিছিয়ে ছিল, সেই সড়কই হতে পারে পাহাড়ের নতুন জীবনধারা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পর্যটন সবকিছুই বদলে দেবে এই ২৪ কিলোমিটার পথ। ৭-৮ ঘণ্টার যাত্রাপথের পরিবর্তে মাত্র ৩ ঘণ্টায় রাঙামাটি পৌঁছানো সম্ভব হবে। তাই সড়কটি দ্রুত নির্মাণে বর্তমান সরকারের হস্তক্ষেপ চাই।
রাঙামাটি সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলেই পথটি সচল হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আমরা একটি ডিও লেটার পেয়েছি। জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সড়কটি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করেছি। যেন ভবিষ্যতে কোনো প্রকল্পের আওতায় উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। সড়কটি নির্মিত হলে রাঙামাটি জেলার সঙ্গে লংগদু-বাঘাইছড়ি উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। পর্যটন এলাকা সাজেকের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে।