হাটহাজারী প্রতিনিধি
বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনের বিজয় অর্জিত হয় ৫ আগস্ট। সারাদেশে এই বিজয় উল্লাস আগেই ছড়িয়ে পড়লেও হাটহাজারীতে চলছিল সংঘর্ষ। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-জনতার বিক্ষোভে সেদিনও গুলি ছুঁড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিকেলের দিকে থানায় বিক্ষুব্ধ জনতার হামলা-ভাঙচুরের মধ্যে পড়ে হাটহাজারী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন রিকশাচালক মো. জামাল মোল্লা (৫২)। ঘড়ির কাঁটা তখন ৬ এর ঘর ছুঁই ছুঁই। পশ্চিম দিগন্তে সন্ধ্যার রঙিন আভা নেমে আসছিল। সারাদেশ তখনো বিজয়োল্লাসে মত্ত। সেই বিজয় উল্লাসের মধ্যেই আন্দোলনের মাঝে পড়ে গুলিবিদ্ধ রিকশাচালক জামাল সেদিন সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে চরম কষ্টে দিনাতিপাত করছে তার পরিবার। মৃত্যুর ২২ দিন পেরুলেও ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক মো. জামাল মোল্লা’র অসহায় পরিবারের খবর নেননি কেউই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেদিন বিকেলে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তাঁর বড় মেয়ের জন্য ছেলে দেখতে গিয়েছিলেন হাটহাজারী পৌরসভার আব্বাছিয়ার পুল এলাকায়। এ সময় সরকারবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি মহাসড়ক অবরোধ করে রাখায় মেয়ের জন্য পাত্র দেখে পরিবারের অন্য সদস্যরা উক্ত মহাসড়কের পশ্চিমে রেললাইন হয়ে বাড়ি ফিরলেও পুলিশের গুলিতে রিকশাচালক জামাল লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।
নিহত রিকশাচালক জামাল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বায়েজিদ থানাধীন কুলগাঁও ট্যানারি বটতলিস্থ মাজার গেট এলাকার ছালে আহাম্মেদ প্রকাশ ফেঞ্জুর বাড়ির ছালে আহাম্মেদের ছেলে। তিনি গত তিন বছর ধরে হাটহাজারী পৌরসভার পশ্চিম দেওয়ান নগর আর্মি ফায়ার সেন্টার সংলগ্ন স›দ্বীপপাড়া হাজীরতলীতে সরকারি জমিতে বসবাস করে আসছিলেন। ছেলে মোহাম্মদ আল-আমিন (১৫) ও মেয়ে তানিয়া আক্তার (১৭) কে নিয়েই তার সাজানো সংসার ছিল। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এমন মৃত্যুতে সংসার চালানোর মতো খরচও সংস্থান করতে পারছেন না স্বামী হারানো তাসলিমা বেগম। দুই সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্নে পতিত এই পরিবারটি এখন আর্থিক সংকটে পড়েছেন। সরকারি পাহাড়ি টিলায় ঘর করতে এনজিও থেকে নেয়া দেড় লক্ষ টাকার ঋণ পরিশোধ নিয়েও পড়েছেন বিপাকে।
গতকাল সোমবার বিকেলে স্বামী হারা তাসলিমা বেগম জানান, আমার স্বামী জামাল মোল্লা ছিলেন পরিবারের একমাত্র ভরসা। ২০০২ সালে আমাদের বিয়ে হয়। রিকশা চালিয়ে আমার দুই সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ চোখের পলকে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এখন আমি নিঃস্ব। কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, আমার স্বামীর কী দোষ ছিল? তিনি তো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাকে হত্যা করা হলো কেন? কেন আমার সন্তানদের এতিম করা হলো? স্বামীর উপার্জনে পরিবার চলত। এখন কিভাবে সংসারের খরচ জোগান দিব? আমার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার চাই। আমার স্বামী নিহত হওয়ার ২২ দিন হলো কেউ আমাদের খবরও নেয়নি। প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও সেনাপ্রধানের বক্তব্য দেওয়ার পর ছাত্র-জনতা আনন্দ মিছিল ও উল্লাস করতে শুরু করেছিল। সেদিন সন্ধ্যা ৬ টার দিকে আনন্দ মিছিল ও উল্লাসের এক পর্যায়ে একদল বিক্ষুব্ধ মানুষ হাটহাজারী মডেল থানার মূল ফটক ভেঙ্গে থানায় প্রবেশ করে প্রথমে ইট পাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর করে। এরপর তারা পুলিশের একটি সাজোয়া যান (এপিসি), একটি পিকআপ ও একটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে।
এ সময় পুলিশ হ্যান্ডমাইকে বারবার বিক্ষুব্ধদের সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। তারপরও বিক্ষুব্ধরা থানায় হামলা চালাতে থাকলে থানা পুলিশ তাদের ভবনের উপর থেকে আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোড়ে। এসময় পুলিশ থানার সামনে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কে এসে বিক্ষুব্ধদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে রিকশাচালক জামালসহ ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এ সময় স্থানীয়রা জামালকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, পরে চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
হাটহাজারী মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (গোয়েন্দা) মো. ছৈয়দ ওমর এর কাছে জানতে চাইলে তিনি নিহত রিকশাচালক জামাল মোল্লার মৃত্যু প্রসঙ্গে কিছু জানেন না বলে জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান উক্ত ঘটনার ব্যাপারে কোনো কিছু জানাতে পারেননি।