আ জ,ম,সামশুল হক
দিন যায়, মাস যায়,নতুন বছরের আগমন ঘটে। নতুন বছর প্রত্যেকের জীবনে আনন্দের। অন্যদিকে জীবন থেকে একটি বছর চলে যাওয়া বেদনার। নতুন বছরে মানুষ আশায় বুক বাঁধে। প্রাপ্তি কম হলে নেমে আসে হতাশা। সংসারে বাড়তে থাকে দুর্ভোগ এবং কষ্টের বোঝা। সমাজে দরিদ্রতা দেখা দেয়। রাষ্ট্র হয় ঋণের চাপে জর্জরিত। বিকল্প পথে সমাধান খুঁজে সরকার। তারপরেও ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত চলার গতি থামেনা। কোনরকমে চালিয়ে যাওয়া এবং সফলতার মধ্যে চালিয়ে যাওয়া বিশাল ফারাক। দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার শুরুতে জনপ্রিয় হলেও বর্তমানে তলানিতে অবস্থান। কেননা, জনগণের জীবন মান উন্নয়নের পথে চেষ্টা করে ও কার্যত: সফল হয়ে ওঠেনি। জনমনে অশান্তি এবং অস্থিরতা, ব্যবসায়ীদের মধ্যে উৎসাহ -উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা, প্রশাসনে স্থবিরতা, অবসরে বাধ্য করা এবং নতুন নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য, পুলিশ বিভাগে গা-ছাড়া ভাব, হাসপাতালে একদিকে ধর্মঘট অন্যদিকে রোগীদের দুর্ভোগ, হাটে-মাঠে- ঘাটে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য, দালালদের ভিড়ে নতুন মামলার জট ইত্যাদি ইত্যাদি পরিলক্ষিত। এতদসত্তে¡ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কৃতিত্ব দেখতে জনগণ উম্মুখ। ‘চাচা আপন জান বাঁচা’ এই নীতিতে একটি দেশ চলতে পারেনা।
অন্তরবর্তীকালীন সরকার অন্যদের থেকে একটু আলাদা। অস্থায়ী সরকার হিসেবে তাঁদের কার্যক্রম সীমিত। তাঁরা অনিয়মিত এবং অনির্বাচিত সরকার বিধায় তাঁদের কাছে প্রত্যাশার দাবি নেই বলা চলে। নির্বাচিত সরকারের মত দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নেই। তাছাড়া আকস্মিক ঝড় বয়ে যাওয়া বাংলাদেশের দুর্যোগ মুহূর্তে সেনাপ্রধানের সহযোগিতায় এই সরকারের আবির্ভাব। তাই আজ অবধি জনগণের সামনে তাঁদের কোন কর্মসূচি এবং রোডম্যাপ নেই। জনগণের হতাশার মধ্যে, দুর্গম পথ চলতে, এই সরকার ক্ষীণ আশার আলো। তবে তাঁদের ভাষ্যমতে, তাঁরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, সঠিক পথের সন্ধানে। জনগণের চাপ না থাকলেও নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ততায় দিন কাটে। পাশাপাশি সদ্য জাগিয়ে ওঠা উচ্চাবিলাসী কতেক নেতৃত্বের চাপে তাঁদের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করে। ভাল কাজের প্রতিশ্রুতি থাকলেও অংকের হিসাবে মন্দের ভাল। নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই সরকারের যতটুকু সফলতা, তা জনগণের মধ্যে প্রতিফলন ঘটুক এবং জনগণের কল্যাণে উদ্ভাসিত হোক, তাই আমাদের প্রত্যাশা। একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার উপহার দেওয়া হবে, এই সরকারের বুদ্ধিদীপ্ত কাজ।
একটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘ ৫৩ বছর পরে রাজনৈতিক ভাবে সংঘটিত হওয়ার প্রয়াসে ২০২৫ কে বেঁচে নিয়েছেন এবং অঘোষিতভাবে রাজনৈতিক মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। সুদূর প্রসারী নির্বাচন করার স্বার্থে নিজেদেরকে সেইভাবে তৈরি করতে প্রস্তুত এবং সংস্কার পরবর্তী নির্বাচন ঘোষণার ব্যাপারে সরকারকে উদবুদ্ধ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি সরকারের কর্মকান্ডকে উৎসাহিত করে চলেছেন। একদিকে নির্বাচন, অন্যদিকে ক্ষমতায়ন। সরকার পড়েছে বেকায়দায়। হাতে যা কাজ আছে, তা সুন্দরভাবে সেরে ফেলা সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। তড়িঘড়ি নির্বাচন, এই সরকারের কাছে বিষফোঁড়া স্বরূপ। তা সত্তে¡ও নির্বাচন উপযোগী গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে নির্বাচন করা হবে, স্বসম্মানে যাওয়ার সুবর্ণসুযোগ। নচেৎ এই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে।
একটি মহল ২০২৫ কে কালো অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করছেন। উক্ত বছর হবে ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী তথা বিগত সরকার গংদের শাস্তি কার্যকরী করার উপযুক্ত সময়। তাই এই বছরে নির্বাচন নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সম্মানিত চিফ প্রসিকিউটরের মতে, ২০২৫ সালে বিচারিক কাজ শেষ করার মধ্যে হবে এই সরকারের সফলতা। সেই আশায় আশান্বিত হয়ে নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা সরকারকে করবে দোদুল্যমান। বিচার ব্যবস্থা বিচারিক নিয়মে হবে। কারও মতামতের ওপর ভিত্তি করে নয়। যারা দুর্নীতি ও লুটতরাজ করেছে, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে ২০২৫ সালের মধ্যে কার্যকরী করা কি সম্ভব হবে।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা গত ডিসেম্বরে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর আহবানে কম -বেশি সাড়া মিলেছে। তবে পরিসংখ্যান মতে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নিস্ক্রিয় ও নিরবতা পালন করেছেন। উল্লেখ্য, অনেক রাজনৈতিক দল সরকারের পক্ষ থেকে ঐক্যের দাওয়াত পাননি। ফলে সরকার কতটুকু লাভবান হয়েছেন, তা সরকারের বিবেচ্য বিষয়।
তাতে প্রতীয়মান হয় যে, নির্বাচিত সাংসদ না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হওয়া কঠিন।কাজেই ২০২৫ এর মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে গভীর সংকট থেকে দেশকে উদ্ধার করা এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে সরকারের জন্য উত্তম কাজ।
২০২৪ এর অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে অনেকের ভাষায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে অপ্রাসঙ্গিক আখ্যা দিয়েছেন। ৭১ মুছে ফেলার কথা বলেছেন। “জয়বাংলা” শ্লোগানের বিলুপ্তি ঘটিয়েছেন। এই দেশে জাতির পিতা বলতে কিছু নেই। তাদের সব বক্তব্য, এই সরকারের গোচরীভুত। তাদের কথাগুলোকে সত্য হিসেবে মনে করলে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটতে বাধ্য এবং জনগণের সাথে যুদ্ধের সামিল। কাজেই ২০২৫ জনগণের জন্য কি বয়ে আনবে, তা ভাববার বিষয়।
ক্ষমতার পালাবদলে বাংলাদেশে তিনটি রাজনৈতিক দলের পরিচয় মিলে। তম্মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। জনগণের অভিমত, এদের বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে, সেই নির্বাচন আলোর মুখ দেখবেনা। ২০২৫ এ হোক বা পরবর্তীতে হোক, সত্যিকার অর্থে, এদের মধ্যে হবে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তাই আসুন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদের মধ্যে বিভেদ না করে অন্তত: নির্বাচনের জন্য ঐক্যমত পোষণ করি এবং সরকারের কাছে নিবেদন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০২৫ সাল জনগণের জন্য উৎসর্গ করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক