এম এ হোসাইন
দীর্ঘ ১৯ বছর বন্ধ থাকার পর চট্টগ্রাম মহানগরীর ঐতিহাসিক প্যারেড ময়দানে আবারও শুরু হতে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ‘তাফসীরুল কোরআন মাহ্ফিল’। ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রামের উদ্যোগে আগামী ২৭ থেকে ৩১ জানুয়ারি (সোমবার থেকে শুক্রবার) পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী এই মাহ্ফিল অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিদিন মাগরিবের পর থেকে প্যারেড ময়দানে এর কার্যক্রম শুরু হবে।
আয়োজকদের ধারণা, মাহফিলে এবার ২০ লক্ষ মানুষের সমাগম হতে পারে। তাফসীরুল কোরআন মাহ্ফিল নিয়ে ইতোমধ্যে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সর্বশেষ ২০০৬ সালে প্যারেড ময়দানে তাফসীরুল কোরআন মাহ্ফিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৯ সালে মাহ্ফিল অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হলেও নিষেধাজ্ঞা জারি থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত তা সম্পন্ন করা যায়নি। ফলে দীর্ঘ ১৯ বছর পর আবার শুরু হতে যাচ্ছে এই মাহ্ফিল।
তাফসীরুল কোরআন মাহ্ফিল আয়োজক কমিটি ইতোমধ্যে প্যারেড ময়দানে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার বর্গফুটের প্যান্ডেলের কাজ শুরু করেছে। আন্দরকিল্লা থেকে পাঁচলাইশ পর্যন্ত এলাকা লোকারণ্য থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ জন্য পুরো এলাকা এলইডি লাইটে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো এলাকায় স্থাপন করা হবে তিন শতাধিক মাইক। আগত মহিলাদের জন্য পাঁচটি স্থানে আলাদা প্যান্ডেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্থানগুলো হলো হচ্ছে কাজেম আলী স্কুল মাঠ, কিশলয় কমিউনিটি সেন্টার, গুল এজার স্কুল, কাপাসগোলা মহিলা কলেজ ও মহসিন কলেজের মাঠ। লোক সমাগম বাড়াতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
তাফসীরুল কোরআন মাহ্ফিল-২০২৫ প্রস্তুতি কমিটির আহব্বায়ক সলীমুল্লাহ জামান বলেন, প্যারেড মাঠ জুড়ে আমরা প্যান্ডেল তৈরি করেছি। ৪৫০ ফুট বাই ৩০০ ফুটের এই প্যান্ডেল। শেষ দিনে আন্দরকিল্লা থেকে পাঁচলাইশ পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হবে। ২০ লক্ষ লোক সমাগম হতে পারে। তিন শতাধিক মাইক স্থাপন করা হবে। পুরো এলাকা এলইডি লাইটের মাধ্যমে আলোকিত করা হবে। নারীদের জন্য পাঁচটি জায়গায় প্যান্ডেল করা হবে। দীর্ঘ ১৯ বছরের বিরতির পর আবার মাহ্ফিল শুরু হচ্ছে। আমরা সবার অংশগ্রহণ কামনা করছি।
এবারের তাফসীরুল কোরআন মাহ্ফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে ধর্ম উপদেষ্টা ডা. আ ফ ম খালিদ হোসেনের। বিশেষ অতিথি হিসেবে ইসলামিক স্কলার হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ কামাল উদ্দিন জাফরী, প্রধান মুফাচ্ছির হিসেবে ডা. মিজানুর রহমান আজহারী (শেষ দিন) উপস্থিত থাকবেন। এছাড়াও অন্যান্য মুফাচ্ছিরদের মধ্যে হযরত মাওলানা মুফতি আমির হামযা, হযরত মাওলানা কামরুল ইসলাম সাঈদ আনসারী, হযরত মাওলানা আবদুল্লাহ্ আল আমীন উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ তাহেরের সভাপতিত্বে এই মাহ্ফিলে আখেরি মুনাজাত পরিচালনা করবেন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিব আওলাদে রসুল (স.) হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ আনোয়ার হোসাইন তাহির জাবিরী আল মাদানী।
এক সময় এই মাহ্ফিলের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন বিশ্ববরেণ্য মুফাসসিরে কোরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (রহ.)। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে টানা পাঁচ দিন এই তাফসির মাহ্ফিলে বয়ান করতেন। দরদমাখা হৃদয়স্পর্শী কণ্ঠে তার বয়ান শুনতে মাহ্ফিলে লাখো মানুষের ঢল নামতো। তথ্য ও যুক্তিনির্ভর বক্তব্য, ভিন্ন ধারায় চুলচেরা বিশ্লেষণ, নির্ভীক ও প্রমিত উচ্চারণ এবং প্রাঞ্জল ও সাবলীল উপস্থাপনার মাধ্যমে আল্লামা সাঈদী এই তাফসির মাহ্ফিলে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করেছেন। মূলত এই মাহ্ফিলের মাধ্যমে আল্লামা সাঈদী দেশ-বিদেশে খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। আল্লামা সাঈদীর বিকল্প হিসেবে এবার তাফসির করবেন দেশের তুমুল জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী। তবে তিনি এই মাহ্ফিলে তাফসির পেশ করবেন কেবল পঞ্চম বা শেষ দিনে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী বর্তমান সময়ে দেশের ধার্মিক তরুণদের আইডল। এই ইসলামিক স্কলার সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বয়ান করে অল্প সময়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন।
জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রাম নগরীর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলে প্রথম তাফসীরুল কুরআন মাহ্ফিলের আয়োজন করে। এক বছর পর সেখান থেকে সরিয়ে কলেজিয়েট স্কুলের মাঠে এই মাহ্ফিলের আয়োজন করা হয়। এরপর এই মাহ্ফিলের আসর বসে লালদীঘি মাঠে। ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতি বছর চকবাজারের প্যারেড ময়দানে পাঁচ দিনব্যাপী এই মাহ্ফিল হয়ে আসছিল। ২০০৬ সালের ২০ থেকে ২৪ ফেব্রæয়ারি প্যারেড ময়দানে সর্বশেষ তাফসীর মাহ্ফিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর পরের দুই বছর তত্ত¡াবধায়ক সরকার এই মাহ্ফিলের অনুমতি দেয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার তাফসীর মাহ্ফিল আয়োজনের চেষ্টা করে ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রাম। ওই বছরের ২৯ মার্চ থেকে তাফসীর মাহ্ফিল আয়োজনের প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। কিন্তু ওই দিন সরকারের নির্দেশে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) প্যারেড ময়দানে ১৪৪ ধারা জারি করে। এরপর থেকে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় ঐতিহাসিক এই আয়োজন।