১৮ মাসে উদ্ধার ২৪৪ লাশ

3

আসাদুজ্জামান রিপন

গত ১৯ জুন মিরসরাই উপজেলার সোনাপাহাড় এলাকায় রেললাইনের ওপর আড্ডা দেওয়ার সময় ট্রেনে কাটা পড়ে ৩ বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান তাদের আরেক বন্ধু রায়হান হোসেন। রায়হান বলেন, ‘রেললাইনের পূর্বপাশ দিয়ে আমরা ৪ বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি পিছনে ট্রেন আসতেছে। বন্ধুদের ডাক দিয়ে প্রাণ রক্ষায় অন্যপাশে ঝাপ দিই। ট্রেন চলে যাওয়ার পর দেখি বন্ধুদের নিধর দেহ পড়ে আছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে দুই সেকেন্ডের মধ্যে। আমরা জানি, এই সময় রেল পশ্চিম পাশ দিয়ে আসার কথা। কিন্তু পূর্ব পাশ দিয়ে চলে আসছে। আমি একটু সামনে থাকাতে বেঁচে গেছি।’ এরপর গত ২৭ জুন বৃহস্পতিবার বিমানবন্দর রেলগেট পারাপারের সময় মৃত্যু হয় এক যুবকের। একইভাবে ১২ জুন বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে হেডফোন কানে লাগিয়ে হাঁটার সময় মৃত্যু হয় আরেক তরুণের। শুধু গত দশদিনেই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের রেললাইনে কাটা পড়ে ৬ জনের মৃত্যু। এর মধ্যে ৩ জনই যুবক।
রেলওয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব মৃত্যুর পিছনে আইন না মেনে রেললাইনে চলাফেরা করা, আড্ডা দেওয়া, অসচেতনতা আর অসাবধানতার বিষয়টি উঠে এসেছে। পাশাপাশি রেললাইনের ওপর বসা বা হেঁটে চলাচল, দ্রæত রেলক্রসিং পার হতে যাওয়া, কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন পার হাওয়া বা হাঁটা, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া, রেললাইনের পাশ দিয়ে নিরাপদ দূরত্ব না মেনে যাতায়াত করা, চলন্ত ট্রেন আসার সময় সেলফি তোলার চেষ্টা ও রেললাইনেকে ব্যবহার করে আত্মহত্যার কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, অসতর্কভাবে রেললাইনে অবস্থান করে ট্রেনে কাটা পড়ে এমন মৃত্যু প্রতিনিয়ত ঘটছে। রেলওয়ে পুলিশের চট্টগ্রাম জোনে (চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলা) ৬ জেলায় গত বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ট্রেনে কাটা পড়ে ১৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে মোট ৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ, গত ১৮ মাসে ট্রেনে কাটা পড়ে ২৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই হিসেবে ওই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানা পুলিশর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, রেলপথ দিয়ে হাঁটা নিষেধ থাকলেও মানুষ অমনযোগী হয়ে রেললাইন দিয়ে হাঁটে। মোবাইলে কথা বলতে বলতে হাঁটে ও রেললাইনে বসে মোবাইল ব্যবহার ও গেমস খেলা এই দুইটি কারণে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে রেলে কাটা পড়ে।
তিনি আরো বলেন, গরমকালে মানুষ বেশি মারা যায় ট্রেনে কাটা পড়ে। গরমকালে মানুষ বিকেলে ও সন্ধ্যায় রেললাইনে বসে আড্ডা দেয়। এই কারণেও মানুষ রেললাইনে কাটা পড়ে মারা যায়। রেলের ওপর উঠে মারা যাওয়ার সংখ্যা অনেক কম।
রেলওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, রেললাইনে কাটা পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় কাউকে দায়ী করা হয় না। রেলের প্রচলিত আইনে রেললাইন ধরে হাঁটা অবৈধ ও দন্ডনীয় অপরাধ। শুধু লাইন নয়, লাইনের দুই পাশ (১০ ফুট করে) ১৪৪ ধারা জারি সর্বদা বহাল রয়েছে। আইন ভঙ্গ করে রেললাইনে প্রবেশে দুর্ঘটনা ঘটলে তা অপমৃত্যু হিসেবে বিবেচিত হয়।
সরেজমিনে চট্টগ্রামের ঝাউতলা, পাহাড়তলী, ষোলশহর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রেললাইনের ওপর বসে মানুষ আড্ডা দিচ্ছে, কেউ কেউ রেললাইনের ওপর দিয়ে যেতে যেতে মোবাইল ফোনে কথা বলছে, আশেপাশের দিকে কোন খেয়াল নেই। এছাড়া ট্রেন অতি নিকটে আসার পরও কয়েকজনকে দৌঁড়ে রেললাইন পার হতে দেখা গেছে।
রেলওয়ে চট্টগ্রাম জেলার কর্মকর্তার বলছেন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলায় রেললাইন রয়েছে। এসব এলাকায় রেলওয়ের বিভিন্ন থানায় প্রায় সাড়ে তিনশ পুলিশ সদস্য কর্মরত আছেন। যা প্রয়োজনের তুলনার অনেক কম। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটনায় কাজ করতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। তাছাড়া, যানবাহন সংকটের কারণে দুর্ঘটনা এলাকায় পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়।
এ বিষয়ে রেলওয়ে চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার শাকিলা সোলতানা বলেন, মানুষের অসতর্কতার কারণেই রেলে কাটা পড়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বয়স্ক, অপ্রকৃতিস্থ মানুষ, মানুষিক রোগী, কানে না শুনা ব্যক্তি বেশি কাটা পড়ে মৃত্যু হয়। আর কোন কোন সময় বাচ্চার মৃত্যু হয়। তবে, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, রেললাইনে কাটা পড়ে সবচেয়ে বেশি তরুণের মৃত্যু হচ্ছে। রেললাইনে মোবাইল ব্যবহারের কারণে ১০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বলে আমি মনে করি। তিনি আরো বলেন, প্রায় প্রতিদিনই রেলে কাটা পড়ার সংবাদ আসে। আমাদের স্বল্প লোকবল দিয়ে এই বিশাল এলাকা কাজ করতে কষ্ট হচ্ছে। প্রতিটি থানায় যে পরিমাণ লোকবল থাকার কথা, সে পরিমাণ এসআই, কনস্টেবলসহ লোকবল কম। এছাড়া দুর্ঘটনা দূরবর্তী জায়গায় হলে যানবাহন স্বল্পতার কারণে সমস্যায় পড়তে হয়।