১৫ বছরে ১১ প্রকল্পেও উপকূলে স্বস্তি ফিরেনি

4

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রামের সাগর উপকূলের বেড়িবাঁধ ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ৩৪ বছরেও স্থায়ী হয়নি। বিভিন্ন সময় ছোটবড় দুর্যোগে উপকূলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বসতভিটা ও ফসলি জমি। ক্ষয়ক্ষতি কমাতে গত ১৫ বছরে শুধুমাত্র সাগর উপকূলেই পানি উন্নয়ন বোর্ড ১১টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এরমধ্যে শেষ হওয়া ৯টি প্রকল্পের ব্যয় হয়েছে দুই হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। চলমান দুটি প্রকল্পে ব্যয় হবে আরও এক হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে প্রায় চার হাজার ৩০০ কোটি টাকা উপকূল সুরক্ষায় ব্যয় করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
পরিবেশবিদ ও উপকূলীয় বাসিন্দাদের মতে, গত ১৫ বছরে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে সেগুলো টেকসই হয়নি। অধিকাংশ প্রকল্প লুটপাট হয়েছে। এখনো ১৯৯১ সালের মতো বড়ধরনের জলোচ্ছ্বাস হলে উপকূলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হবে। অনেক এলাকা এখনো বেড়িবাঁধের আওতায় আসেনি। বালির বস্তা ও জিও ব্যাগ দিয়ে বাঁধ প্রতিরক্ষা করা হয়েছে। যে বাঁধগুলো জলোচ্ছ্বাস থামানোর মতো অবস্থায় নেই। প্রতিদিনই ভাঙন এলাকা বাড়ছে। প্রকল্প নিয়ে বছরের পর বছর পার করে পানি বোর্ড। প্রকল্প বাস্তবায়নকালেই বেড়িবাঁধে নতুন করে ভাঙন হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব এতে অধিক উচ্চতায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করলে আগামীতেও পানির নিচে থাকবে উপকূল।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ.ম জুলফিকার তারেক পূর্বদেশকে বলেন, ‘আগে যে বেড়িবাঁধগুলো নির্মিত হয়েছে সেগুলোর উচ্চতা আর এখন নির্মিত হতে যাওয়া বেড়িবাঁধের উচ্চতার মধ্যে পার্থক্য আছে। এখন অনেক বেশি উচ্চতায় এবং ভারী ব্লকে বাঁধ নির্মিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের সাগর উপকূলের প্রায় এলাকা বাঁধের আওতায় এসেছে। এখনো যেসব এলাকা বাঁধের আওতায় আসেনি সেগুলোও আমরা প্রতিরক্ষা করেছি। এখন উপকূলীয় এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকে না।’
পাউবোর তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চট্টগ্রামের সাগর উপকূলে ১১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এরমধ্যে ২০১০ সালে সীতাকুন্ডে জরুরি দুর্যোগ ক্ষতি পুনর্বাসন প্রকল্প (ইডিডিআরপি) চার কোটি টাকা, সন্দ্বীপে ইডিডিআরপি চার কোটি টাকা, ২০১৭ সালে সন্দ্বীপ, মিরসরাই ও সীতাকুন্ডে বিভিন্ন অবকাঠামো সমূহের ভাঙন প্রতিরোধ, নিষ্কাশন এবং সেব ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ৯৫ কোটি টাকার পুনর্বাসন প্রকল্প, ২০২১ সালে বাঁশখালীর পুঁইছড়িতে পুনর্বাসন ও নিষ্কাশন প্রকল্পে ১১ কোটি টাকা, ২০২২ সালে বাঁশখালী পোল্ডার নং ৬৪/১এ, ৬৪/১বি, ৬৪/১সি এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত অংশের স্থায়ী পুনর্বাসন প্রকল্পে ২৮৩ কোটি টাকা, ২০২২ সালে সন্দ্বীপে পোল্ডার নং ৭২ এর ভাঙনপ্রবন এলাকায় স্লোপ প্রতিরক্ষা কাজের মাধ্যমে পুনর্বাসন প্রকল্পে ১৯৯ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে বাঁশখালীতে নদী সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং শহর সংরক্ষণ প্রকল্পে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এছাড়াও ২০২৪ সালে মিরসরাই শিল্পাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সড়ক কাম বেড়িবাঁধ প্রতিরক্ষা ও নিষ্কাশন প্রকল্প এক হাজার ৬৩৬ কোটি ব্যয় হয়েছে। আনোয়ারায় ২০২১ সালে ৫৭৭ কোটি টাকা ব্যয় বেড়িবাঁধ উন্নয়ন হয়েছে। এছাড়াও সন্দ্বীপে ৫৬২ কোটি টাকা এবং বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপকূলের স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণে ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্প ২০২৪ সালে অনুমোদন হয়েছে। এ দুটি প্রকল্পের কাজ এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। অন্যদিকে সীতাকুন্ড ও সন্দ্বীপের উড়িরচর উপকূল সুরক্ষায় আরো দুটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাঁশখালী উপকূলে ৩৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। এরমধ্যে ছনুয়া, খানখানাবাদ, বাহারছড়া এলাকায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ থাকলেও কাথরিয়া, সরল, গন্ডআমারা এলাকার অধিকাংশ এলাকা এখনো অরক্ষিত। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এসব এলাকার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল বেশি। নতুন প্রকল্পেও এসব এলাকা অন্তর্ভূক্ত হয়নি। সর্বশেষ শেষ হওয়া প্রকল্পের তিন বছর না যাতেই বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আনোয়ারায় সাগর উপকূলের গহিরা, জুঁইদন্ডীর অনেক এলাকা এখনো পুরোপুরি সুরক্ষিত হয়নি। এ এলাকায় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও এখনো অনেক জায়গা জিওব্যাগ দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছে। সীতাকুন্ডের বাড়বকুন্ড, কুমিরা, সৈয়দপুর, সলিমপুরের অনেক এলাকায় এখনো বেড়িবাঁধের আওতায় আসেনি। মিরসরাইয়ে শিল্পাঞ্চলের কারণে বেশকিছু এলাকা সুরক্ষিত হলেও উপকূলের তিনটি ইউনিয়ন এখনো বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়নি। সন্দ্বীপের কালাপানিয়া, হরিশপুর, রহমতপুর, আজিমপুর, মাইটভাঙ্গা, মুছাপুর, মগধরা ও সারিকাইত ইউনিয়ন ভাঙ্গন প্রবণ। বিগত সময়ে সেখানে নেয়া প্রকল্পের সুফল মিলেনি। নতুন প্রকল্পের কাজ এখনো পুরোপুরি শুরু না হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় আতঙ্ক বিরাজ করছে এই দ্বীপে।
বাঁশখালীর গন্ডামারা এলাকার বাসিন্দা সৈয়দুল আলম বলেন, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালীতে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল গন্ডামারায়। ২০১২ সালের দিকে একবার মাটি ভরাটের কাজ হলেও এরপর স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়নি। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়া সেদিকে কিছু এলাকা সুরক্ষিত হয়েছে। এখনো বেশিরভাগ এলাকা অরক্ষিত। বড়ধরনের জলোচ্ছ্বাস হলেই নির্ঘাত আবারো প্রাণহানি ঘটবে।
আনোয়ারার গহিরা এলাকার বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, ‘আনোয়ারা উপকূলে বেড়িবাঁধ নির্মিত হলেও তার সুফল মিলেনি। অনেক এলাকা এখনো অরক্ষিত। নতুন প্রকল্পে কাজ হলে হয়তো সুরক্ষিত হবে। তবে টেকসই বাঁধ নির্মিত না হলে তা কয়েক বছরের মধ্যেই আবারো বিলীন হয়ে যাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড যে কাজগুলো করে সেগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।’

ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ : ১৯৯১ সালের এইদিনে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাঁশখালী, আনোয়ারা, সীতাকুন্ড, মীরসরাই, সন্দ্বীপসহ উপকূলীয় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে দেশে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রান হারিয়েছিল। প্রায় এক কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়েছিল। প্রলয়ংকরী এই তান্ডবের ৩৪ বছরেও উপকূলীয় এলাকাগুলোতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ হয়নি। দিনটিকে স্মরণ করে উপকূলীয় এলাকায় নানা সংগঠন কর্মসূচি পালন করে।