১০ বছরের পরিকল্পনা ৭ বছর ‘ফাইলবন্দি’

4

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন ও পাহাড়ে বসতি নির্মাণের কারণে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে এশিয়ান হাতি। দেশে প্রতি বছর হাতি মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ায় এ সংকট আরো বেশি ঘনিভূত হয়েছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ইউনিয়ন (আইইউসিএন) হাতিকে বাংলাদেশে ‘মহাবিপন্ন প্রজাতি’ প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অথচ হাতি সংরক্ষণে ২০১৮ সালে ১০ বছর মেয়াদে ‘বাংলাদেশ হাতি সংরক্ষণ কর্ম পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করেছিল সরকার। ছয়টি উদ্দেশ্যে নেয়া এ পরিকল্পনার মেয়াদ শেষ হতে তিন বছর বাকি থাকলেও এখনো ছিটেফোটাও বাস্তবায়ন হয়নি। ‘ফাইলবন্দি’ অবস্থায় কেটে গেছে হাতি সংরক্ষণ পরিকল্পনার সাত বছর।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ পূর্বদেশকে বলেন, ‘হাতি সংরক্ষণে কোন প্রকল্প নেয়া হয়নি। সুফল প্রকল্পের অধীনে একটি এনজিও হাতি নিয়ে কাজ করেছে। তবে কাজগুলো তেমন ভালো হয়নি। আমিও কাজগুলো নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। হাতি সুরক্ষায় কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কাজ করা দরকার ছিল। কোন কাজই হয়নি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার উদ্যোগ নিয়ে অনেক ভালো হবে। এই কর্মপরিকল্পনার সময়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা দরকার। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সাইটটা খুবই অবহেলিত। বর্তমান উপদেষ্টা মহোদয় দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে হাতি সুরক্ষায় গুরুত্ব দিয়েছেন।’
প্রতি বছরই চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাতি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গত তিন মাসে চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিনটি হাতি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত ১৪ অক্টোবর চুনতি অভয়ারণ্যে ট্রেনের ধাক্কায় একটি, গত ৫ জানুয়ারি টেকনাফের হোয়াইক্যং রেঞ্জের হরিখোলা পাহাড়ে বাচ্চা প্রসবের পর একটি ও বান্দরবানের লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের চাককাটা এলাকায় বিদ্যুতায়িত হয়ে একটি হাতির মৃত্যু হয়। বেসরকারি তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেশে প্রায় ৩৪টি হাতি মারা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাসময়ে হাতি সংরক্ষণ কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে হাতি মৃত্যু কিংবা হত্যা অনেকাংশে কমে যেতো। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের বনাঞ্চল, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম ও মৌলভীবাজারের বনাঞ্চলে প্রায় ৩০০টির মতো হাতির বিচরণ আছে।
২০১৮-২০২৭ সাল পর্যন্ত দশ বছর মেয়াদী হাতি সংরক্ষণ কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা চাওয়া হয়। মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব, হাতি শিকার কমানো, বাসস্থানের ক্ষতিরোধ করা এবং খাদ্যের পর্যাপ্ত বৃদ্ধি, হাতি এবং তাদের আবাসস্থলের সুরক্ষা উন্নত করা, গবেষণা বাড়ানো এবং জ্ঞান উন্নত করা, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা, স্টকহোল্ডারদের সচেতন করার মতো ছয়টি উদ্দেশ্যে এই কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়। এ পরিকল্পনায় হাতি জনসংখ্যার জন্য তিনটি হুমকি ও পাঁচটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়। হাতির জন্য খাদ্য অপর্যাপ্ততা, বাসস্থানের ক্ষতি এবং খÐিতকরণ ও সরাসরি হাতি হত্যাকে হুমকি ধরা হয়েছে। পাশাপাশি গবেষণা এবং জ্ঞান ব্যবস্থাপনা, নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণ, বন সুরক্ষা এবং প্রয়োগ, যোগাযোগ, শিক্ষা এবং জনসাধারণ সচেতনতা এবং সহযোগিতাই হাতি সুরক্ষায় চ্যালেঞ্জ।
বন কর্মকর্তারা জানান, হাতি হলো সবচেয়ে বড় স্থলজ স্থন্যপায়ী প্রাণী। হাতি সাধারণত প্রতিদিন ১৫০ কেজি উদ্ভিদ এবং ১৪০ লিটার পানি খায়। গাছের শিকড়, পাতা, ঘাস, লতা, গুল্ম, ডালপালা ও ছাল বেশি খায় হাতি। হাতি নিয়মিত খাদ্য, জল ও আশ্রয়ের খোঁজে বনাঞ্চলে ঘুরঘুর করে। খাদ্য অপর্যাপ্ততা হলেই লোকালয়ে প্রবেশ করে। শিল্পায়ন, উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে হাতির বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাতি চলাচলের ১২টি করিডোরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে হাতি নির্দিষ্ট বিচরণক্ষেত্র ছেড়ে অন্য বনাঞ্চল কিংবা লোকালয়ে যাচ্ছে। এতে মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্ব বাড়ছে। হাতির বিচরণক্ষেত্রে মানুষের পদচারণায় বাড়ায় হাতি ও মানুষের মধ্যে প্রতিশোধ প্রবণতাও বেড়েছে। হাতি যেমন মানুষ মারছে তেমনি মানুষ কর্তৃক হাতি হত্যা বাড়ছে। হাতি সংরক্ষণে নেয়া অ্যাকশন প্ল্যানে হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হাতি সুরক্ষার জন্য সহায়ক হতো। এছাড়াও ২০২২ সালে হাতি সুরক্ষায় নেয়া ৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব দেয়া হলেও সেটিও অনুমোদন হয়নি।
গত ১৭ অক্টোবর হাতি সংরক্ষণে দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম গ্রহণ করবে বলে জানান পরিবেশ, ‘বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, স্বল্পমেয়াদী কার্যক্রমের আওতায় হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থল উন্নয়ন, নিরাপদ প্রজনন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, হাতির সংখ্যা নিরূপণ ও গবেষণা, এবং মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়াও, হাতি সংরক্ষণে জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম জোরদার করা হবে। হাতি বসবাসের এলাকা চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রংপুর বিভাগের কয়েকটি জেলায় এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। হাতি সংরক্ষণ দেশের জীববৈচিত্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। এ কার্যক্রমে সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে মানুষের জানমাল সুরক্ষার পাশাপাশি হাতির অস্তিত্বও টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।