অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইকবাল
এক.
“শিশু-কিশোরদের দরবারে নিয়ে আসা ভাল। এতে তাদের আদব-আখ্লাক ও বুঝ-জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে।”
-বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারি (ক.)
গভীর তাৎপর্যপূর্ণ শাশ্বত এই বাণীটিকে ‘মটো’ হিসেবে ধরে নিয়ে বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারির (ক.) শোণিত ও বেলায়তের একমাত্র উত্তরাধিকারী, রাহবারে আলম, হযরত শাহসুফি সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মাইজভান্ডারির (ম.) সৃজনশীল প্রজ্ঞা ও সুউচ্চ কল্যাণকামী চিন্তা-চেতনার ফসল হলো ‘শিশু-কিশোর সমাবেশ’। হুজুর গাউসুল আযম মাওলানা শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারির (১৮২৬-১৯০৬) ওফাত শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে দরবারে গাউসুল আযম মাইজভান্ডারি, গাউসিয়া হক মনজিলের উদ্যোগে ২২ জানুয়ারি ২০০৬ খ্রিস্টাব্দ প্রথম শিশু-কিশোর সমাবেশের আয়োজন করা হয় গাউসিয়া হক মনজিলের শান্তিকুঞ্জ প্রাঙ্গণে। এরপর দ্বিতীয় শিশু-কিশোর সামবেশ অনুষ্ঠিত হয় ১৫ জানুয়ারি ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে একই স্থানে গাউসিয়া হক মনজিল এবং ‘মাইজভান্ডারী একাডেমি’র যৌথ উদ্যোগে। এবছর প্রথম শিশু-কিশোর সমাবেশ উপলক্ষ্যে হামদ/না’ত, মাইজভান্ডারি গান, কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা ও কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর একই নিয়মে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয়, ২০১১ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ এবং ২০১২ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম শিশু কিশোর সমাবেশ একই স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। ১৮ জানুয়ারি ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত হয় এই আয়োজনের ষষ্ঠ আসর। এই আয়োজনটি ছিল পূর্ববর্তী আয়োজন থেকে ভিন্ন ও নতুন মাত্রার। ষষ্ঠ শিশু কিশোর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম মহানগরের নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। দরবারী অঙ্গনের বাইরে এসে এ বছর এই আয়োজনটি রূপ নেয় জাতীয় শিশু-কিশোর সমাবেশে। আগের আয়োজনগুলোতে দরবারী আশেক-ভক্তগণের ছেলে-মেয়েরা অংশ নিলেও ষষ্ঠ শিশু কিশোর সমাবেশে অংশ নেয় চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন সহ¯্রাধিক শিশু-কিশোর। এরপর থেকে এই আয়োজনের আকার ক্রমশ বৃদ্ধি হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ ফেব্রæয়ারি ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে সপ্তম, ১৬ জানুয়ারি ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে অষ্টম, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে নবম, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে দশম, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে একাদশ, ১৮ জানুয়ারি ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে যুগপূর্তি ও শিশু-কিশোর সমাবেশ, ১৭ জানুয়ারি ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ত্রয়োদশ, ১৪ জানুয়ারি ২০২২ খ্রিস্টাব্দে চতুর্দশ, ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চদশ এবং ১৬ ফেব্রæয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে ষোড়শ শিশু-কিশোর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ষোড়শ শিশু-কিশোর সমাবেশে চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহ হতে ছয় সহস্রাধিক শিশু-কিশোর অংশগ্রহণ করে।
যুগ চাহিদার আলোকে প্রবর্তিত মাইজভান্ডারিয়া তরিকা ও দর্শনের চর্চার কেন্দ্র ও বিশ্ব সমাদৃত মাইজভান্ডার দরবার শরিফের ব্যাপক যুগোপযোগী প্রত্যয়দীপ্ত সৃজনশীল ও জনকল্যাণকর কর্মযজ্ঞে অংশ হলো এই সমাবেশ, যা শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক মহিমার আলোকে একটি মহিমান্বিত স্রোতধারায় সমবেত করে। শিশু-কিশোরদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক, পরমতসহিষ্ণু ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে পরিশুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই আয়োজন অতীব কার্যকরী, বিজ্ঞান সম্মত ও যুগোপযোগী হিসেবে প্রমাণিত হয়ে শিশু-কিশোর ও অভিভাবক সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে তথ্যবহুল, বস্তুনিষ্ঠ বিষয় পরিবেশনের পথিকৃত হয়ে শুরু থেকেই সহ¯্র শিশু-কিশোরদের অন্তঃস্থলে স্থান করে নিয়েছে এই ধারাবাহিক বর্ণাঢ্য আয়োজন। এই আয়োজন শিশু-কিশোরদের জন্য আজ আলোর দিশারী হিসেবে ভূমিকা রাখছে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন। চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী এই ব্যতিক্রমধর্মী ‘শিশু-কিশোর সমাবেশ’ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ১৬ বছরের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এই আয়োজন হয়েছে ধারাবাহিকভাবে সমৃদ্ধ। দেশব্যাপী সাড়া জাগানো এই আয়োজনের জন্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশের শিশু-কিশোররা আজ অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে সারা বছর।
দুই.
দুই পর্বে এই আয়োজন সম্পন্ন হয়। প্রথম পর্বে থাকে প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার বিষয়গুলো হলো- ক্বিরাত, হামদ/না’ত, দেশাত্মবোধক গান, মাইজভান্ডারি সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, উপস্থিত বক্তৃতা, ঝঢ়বষষরহম ইবব, রচনা, ফটোগ্রাফি, ভিডিও কন্টেন্ট/সীমিত চলচ্চিত্র, আইডিয়া হান্ট, বিজ্ঞান মেলা, যেমন খুশি তেমন সাজো এবং কুইজ। প্রতি বছর আরও নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হচ্ছে। সাধারণত মূল সমাবেশের এক সপ্তাহ আগে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয় পর্বে থাকে পুরস্কার বিতরণী, শিশু-কিশোর সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা। এই দিন মঞ্চে উপস্থাপন করা হয়- সুললিত কণ্ঠে পবিত্র কুরআনের বাণী, হামদ/না’ত, জাতীয় সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, মাইজভান্ডারি সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি, পাপেট শো, শিশুতোষ নাটক, মূকাভিনয়, বিনোদনমূলক যাদু প্রদর্শনী, ক্যারিয়ার গঠনের জন্য দিক-নির্দেশনামূলক আলোচনা, জাতীয় দলের ক্রিকেটার বা ফুটবলারদের মুখ থেকে সফলতার গল্প, কর্ম ক্ষেত্রে সফলদের সফলতার গল্প।
আর প্রদর্শনী ও মেলাতে থাকে বিজ্ঞান মেলা, বই মেলা, ছবি মেলা, বৃক্ষ পরিচিতি, ফায়ার সার্ভিসের প্রদর্শনী ও পরিচিতি, রেড ক্রিসেন্ট পরিচিতি, স্কাউট পরিচিতি, পিঠাপুলির দোকান, এসো কিছু করি (সৃজনশীল উদ্ভাবনী), শফি মামার দোকান, টেলিস্কোপ-এর ব্যবহার, ইসলামিক ঐতিহাসিক দুর্লভ ছবির প্রদর্শনী মহাবিশ্বের ধাঁধা, মিনি অলিম্পিয়াড। এই আয়োজনকে আবার কয়েকটি জোনে ভাগ করা হয়। সেগুলো হলো- গাউসুল আযম মাইজভান্ডারি তোরণ, বাবা ভান্ডারি তোরণ, দেলা ময়না বিজ্ঞান মেলা, শাহানশাহ্ মাইজভান্ডারি তোরণ এবং রাহবার তোরণ।
সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে এই আয়োজন চলতে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। মাঝে আবার দুপুরের খাবার ও নামাযের জন্য বিরতি থাকে। এই উপলক্ষ্যে আয়োজক সংস্থা বরেণ্য লেখক-সাহিত্যিক ও নতুন প্রজন্মের লেখকগণের গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, সাইন্স ফিকশন, অভিজ্ঞতা, ক্যারিয়ার গাইড বিষয়ক লেখায় সাজিয়ে ‘মাঘ উৎসব’ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করে থাকে। এর সাথে থাকে প্রতি বছর একটি নতুন গল্পের বই। যা আবার ফ্রিতে বিতরণ করা হয় শিশু-কিশোরদের মধ্যে।
তিন.
আধুনিক, দেশপ্রেম ও নৈতিক শিক্ষায় উদ্দীপ্ত এবং বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গঠনের লক্ষ্যে এই অত্যন্ত মানসম্পন্ন ও ভিন্নমাত্রিক আয়োজনে অবদান আজ স্বীকৃত। প্রতি বছর এই আয়োজনে অংশ নেয় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোর। এই সমাবেশের অর্জনও কম নয়। একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বিশেষ করে নব প্রজন্মকে ধর্মীয় অনুশাসন মানা ও আধ্যাত্মিকতার দিকে আগ্রহী ও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হওয়াই এই আয়োজনের বড় অর্জন। এছাড়াও অসাম্প্রদায়িক ও পরমতসহিষ্ণুতার চেনার বীজ পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বপন করতে পারা, শিশু-কিশোরদের সংস্কৃতিক ও সৃজনশীল প্রতিযোগিতায় আকৃষ্ট করা, হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া, নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধির শিক্ষার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ, শিশু-কিশোরদের সুপ্ত মেধা বিকাশকরণ ইত্যাদিও এই আয়োজনের অর্জন। আবার এই প্রতিযোগিতা হতেই উঠে এসেছে নয়ন শীল ও ইলমা বখতেয়ারের মত দেশ বিখ্যাত শিল্পীগণ। এই ধারা সতত প্রবহমান।
চার.
খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতামূলক এই আয়োজনে মাধ্যমে আজকের শিশু-কিশোরদের উন্নত নৈতিক গুণাবলীর অধিকারী সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা এবং তাদের জ্ঞান গরিমায় আরও সচেতন করাই মাইজভান্ডারি একাডেমির উদ্দেশ্য। প্রায় দেড় যুগের ধারাবাহিকতায় মাইজভান্ডারিয়া তরিকা ও দর্শনের প্রবর্তক এবং মাইজভান্ডার দরবার শরিফের অধ্যাত্ম শরাফতের প্রতিষ্ঠাতা গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারির (ক.) ১১৯তম বার্ষিক উরস শরিফ উপলক্ষ্যে তাঁরই যোগ্যতম উত্তরসূরি রাহবারে আলম সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মাইজভান্ডারির দিকনির্দেশনায় সুপরিচালিত ‘শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (ক.) ট্রাস্ট’ নিয়ন্ত্রণাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘মাইজভান্ডারী একাডেমি’ কর্তৃক ‘সপ্তদশ শিশু-কিশোর সমাবেশ-২০২৫’ এর আয়োজন করা হয়েছে আগামী ১০ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ নাসিরাবাদ সরকারি (বালক) উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এবং এই উপলক্ষ্যে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে ৩ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ নাসিরাবাদ সরকারি (বালক) উচ্চ বিদ্যালয়ে সকাল ৯.৩০ মিনিট থেকে। আর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য ফরম পাওয়া যাবে শিল্পকলা একাডেমি চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি চট্টগ্রাম, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, আলোকধারা বুকস্ (সাফ আমিন, চকবাজার), গণি স্টোর (চেরাগী পাহাড়), মাইজভান্ডারী একাডেমি কার্যালয়, গাউসিয়া হক ভান্ডারি খানকাহ্ শরিফ (বিবিরহাট) এবং গাউসিয়া হক মনজিল, মাইজভান্ডার দরবার শরিফে। এছাড়াও ফেসবুক পেইজ হলো ‘মাঘ উৎসব- শিশুকিশোর সমাবেশ’।
প্রতিবারের মতো এবারও এই আয়োজন সফল ও সার্থক হবে এই কামনা করি।
লেখক : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক