হেলালের দোষে ফাঁসতে পারেন ইসির ১০ কর্তা

5

নিজস্ব প্রতিবেদক

লাকী আক্তার ও নুর আলম নামে দুই রোহিঙ্গাকে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদানের ঘটনা ধরা পড়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড় হয়। এ ঘটনায় তড়িঘড়ি করে নির্বাচন কমিশন মামলা দায়ের করে। মামলার তদন্ত শুরু করে কাউন্টার টেররিজম। মামলায় ইসির বেশ কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ধরা পড়ে জেল খাটেন নির্বাচন কমিশনের কয়েকজন কর্মচারী। কিন্তু বরাবরের মতো আড়ালে থাকেন ঘটনার সাথে জড়িত কিংবা গাফিলতিতে জড়িত নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
ইসির সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তারের পর রোহিঙ্গা ভোটার কেলেঙ্কারি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। দুদকের জালে ফাঁসতে পারেন তৎকালীন চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কর্মরত থাকা ডজনখানেক ইসি কর্মকর্তা।
হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে ৫৫ হাজার ৩১০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে অভিযোগটি অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সাবেক এই প্রভাবশালীর অনিয়ম খুঁজতে দুদকের সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলমকে অনুসন্ধানী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। কমিশনের তরফ থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সাবেক নির্বাচন কমিশনের এই সচিবের সব দুর্নীতির প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। সেই হিসেবে গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে হেলালুদ্দীন আহমদ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একই চিঠি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও পাঠিয়েছে দুদক।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম জানান, ‘সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের বিষয়টি জানি। কিন্তু বিস্তারিত তথ্য আমার কাছে নাই।’
এদিকে রোহিঙ্গা ভোটার করা নিয়ে সাবেক ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের অনিয়ম তদন্ত শুরু হয়েছে এমন খবরে আতঙ্ক বিরাজ করছে ইসিতে। এর আগে রোহিঙ্গা ভোটার করার ঘটনায় বেশ কয়েকজন কর্মচারী কারাগারে গেলেও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জোরালো কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এবার হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে ৫৫ হাজার ৫৫ হাজার ৩১০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে এনআইডি দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণ হলে ইসির আরও ডজনখানেক কর্মকর্তা ফেঁসে যেতে পারেন। যারা ওই সময়ে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস, চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিস, কক্সবাজার নির্বাচন অফিসে কর্মরত ছিলেন।
রোহিঙ্গাদের এনআইডি দেওয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে আসা ইসি কর্মচারী জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমাদের মতো ছোট কর্মচারীদের সাথে অবিচার করা হয়েছে। অথচ বড় কর্মকর্তাদের কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চাইলেও কোনো কর্মচারী কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ছাড়া রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে পারবে না। গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজন কর্মচারী মামলার জবানবন্দিতে কয়েকজন কর্মকর্তার নামও বলেছে। তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। শুনছিলাম দুদক পাঁচজন কর্মকর্তাকে নোটিশ করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু কোনরূপ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এনআইডি কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার সময় যেসব কর্মকর্তা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন তাঁরাও এখন দেশের বিভিন্ন নির্বাচন অফিসে কর্মরত আছেন। এরমধ্যে তৎসময়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান নির্বাচন কমিশনে পরিচালক, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন খান কুমিল্লা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা খোরশেদ আলম নির্বাচন কমিশনে উপসচিব, পাঁচলাইশ নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখ অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, কক্সবাজারের জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হোসেন মুন্সিগঞ্জ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, রামুর নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজুল ইসলাম চকরিয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, কক্সবাজার সদরের নির্বাচন কর্মকর্তা শিমুল শর্মা লক্ষীপুরের রায়পুর নির্বাচন কর্মকর্তা, ডবলমুরিং নির্বাচন কর্মকর্তা পল্লবী চাকমা ফেনীর সোনাগাজী নির্বাচন কর্মকর্তা, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুল আলম খাগড়াছড়ি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, সীতাকুÐের নির্বাচন কর্মকর্তা আশরাফুল আলম ফেনীর অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা পদে কর্মরত আছেন। ওই সময়ে এরা প্রত্যেকেই রোহিঙ্গা ভোটার করার সাথে সংশ্লিষ্ট অফিসে কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে খোরশেদ আলম ও আব্দুল লতিফ শেখের বিরুদ্ধে মামলা হলেও কোনরূপ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় নির্বাচন কমিশনে কর্মরত থাকা এই কর্মকর্তাদের নামই কোন না কোনভাবে আলোচনায় ছিল।
জানা যায়, ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে হাটহাজারীর মির্জাপুর ইউনিয়নের ঠিকানা ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে লাকী আক্তার নামে এক রোহিঙ্গা নারী এনআইডি পায়। পরে পাসপোর্ট করতে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে স্মার্ট কার্ড সংগ্রহ করতে গেলে তার জালিয়াতি ধরা পড়ে। এ ঘটনায় লাকী আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিশের সাথে গোলাগুলিতে রোহিঙ্গা ডাকাত নুর আলম নিহত হয়। এসময় তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় একটি স্মার্ট কার্ড। একজন রোহিঙ্গা হয়েও নুর আলম কিভাবে স্মার্ট কার্ড পেয়েছে তা আলোচনার জন্ম দেয়। অনুসন্ধানে উঠে আসে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশী ভোটার স্মার্ট কার্ড পায় নুর আলম। সেই সময় কক্সবাজার থেকে না করে চট্টগ্রাম থেকেই নুর আলম স্মার্ট কার্ড প্রস্তুত করে বলে আলোচনায় আসে।
মূলত এ দুটি ঘটনা তোলপাড় শুরু হলে বড় ধরনের এনআইডি কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়। এসব ঘটনায় মামলার প্রেক্ষিতে কয়েকজন কর্মচারী গ্রেপ্তার হয়। সেই সময় ঘটনাটি অনুসন্ধান শুরু করেও মাঝপথে থমকে যায় দুদক। এমনকি ২০১৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর তদন্তের স্বার্থে দুদকের একটি অনুসন্ধানী টিম চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে অভিযান চালায়।
সেই সময় দুদক জানায়, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কাজে ব্যবহৃত আটটি ল্যাপটপ হারিয়ে যাওয়ার তথ্য পায় দুদক। তবে সাতটি ল্যাপটপের ব্যাপারে জিডি ও মামলা রেকর্ড করাসহ আইডি বøক করার কথা জানানো হলেও ইসির দাবি করা মিরসরাই থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি ল্যাপটপের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ৪৩৯১ আইডি নম্বরের ল্যাপটপটি দিয়েই মূলত বড় ধরনের এনআইডি জালিয়াতি করা হয়েছে। ওই একটি ল্যাপটপ দিয়েই ২০১৬ সাল থেকে টানা ৩ বছর ধরে ৫৫ হাজার ৩১০ জন রোহিঙ্গাকে ভোটার বানানো হয়েছে। যাদের মধ্যে প্রায় ৪৫ হাজারই কক্সবাজারের ঈদগাঁও এলাকার বাসিন্দা।
অনুসন্ধানী দল ইসি’র সার্ভারে ঢুকে দেখতে পায়, ভোটার হওয়ার জন্য যে নিবন্ধন ফরম ব্যবহার করা হয় তার সিরিয়াল নম্বর ৪১৮৬৬৩০১ হতে ৪১৮৬৬৪০০ পর্যন্ত ১০০টি ফরমের একটি বই একটি অফিসের নামে ইস্যু করার নিয়ম থাকলেও এর ৬৩টি ফরম দেশের ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবহার করা হয়েছে। যে ল্যাপটপ থেকে ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে ভোটার বানানো হয়েছে, তাদের কারোর ক্ষেত্রেই পূর্ণাঙ্গ কাগজপত্র আপলোড করা হয়নি নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে। সেই সময় দুদকের যে কর্মকর্তা এনআইডি জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করেছিল সে কর্মকর্তাকে চাপ দেয়ার অভিযোগ উঠে হেলালুদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে। যে কারণে ইসির কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই এমন অপকর্ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
দুদকের পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব পালনকালে হেলালুদ্দীন আহমদ রোহিঙ্গাদের ভোটার করেছেন এমন অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও ২০১৮ সালের ভোটগ্রহণ নিয়েও তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ আছে। এসব কাজ করতে অবশ্যই তিনি ইসির একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের ব্যবহার করেছেন। সেই সময় কে কোথায় দায়িত্ব পালন করেছে সেগুলো আমরা খোঁজ নিব। কারও বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’