সালাহ উদ্দিন শুভ্র
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে বড় ঘটনা-এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যদিও আমরা ধরে নিই এর প্রধান কারণ পাঠক। তিনি যে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তা সাহিত্যের ক্ষেত্রে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাংলাদেশের সমাজে আর ঘটে নাই। আমরা কাসেম বিন আবুবাকার বা এম ডি মুরাদের নাম যদিও শুনেছি। তারা মফস্বল এলাকায় কলেজে পড়তে আসা অথবা মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের তরুণদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় ছিলেন। তাদের সাহিত্যের মান সত্যি বলতে আলোচনার যোগ্য কখনো হয়ে উঠতে পারেন নাই আমার কাছে। তবে তারা বইয়ের যে কালচার, সেটা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। আশি-নব্বই দশকের মফস্বল এলাকায় বিয়ের উপহার হিসেবে বা প্রেম নিবেদনের সময় অথবা লাইফস্টাইল তৈরিতেও এ ঘরানার বইয়ের ভূমিকা আছে। এসব কারণে তারা বই বিক্রির বিবেচনায় বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা বুঝতে অবশ্যই আলোচনার যোগ্য। এখনো এ ধারার কোনো কোনো লেখক বেশ বাজার পেয়েছেন, তবে তারা গল্প-উপন্যাস লেখেন না। হুমায়ূন আহমেদের বিষয়টা ভিন্ন, তিনি খোদ ঢাকায় বসে, সংস্কৃতির কেন্দ্র যে মধ্যবিত্ত তার ভেতরে ঢুকে পড়তে পেরেছেন। যে কারণে তাকে নিয়ে আলাপ করতে আমরা বাধ্য হই। তার এই জনপ্রিয়তার সাহিত্যিক বা রাজনৈতিক গুরুত্বকে অস্বীকারের উপায় নাই। তাকে বুঝার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের একটি অংশের মনোজগত বুঝা সম্ভব।
যেমন তার মৃত্যুর পর কেউ কেউ আমাকে বলেছিলেন যে, মন খারাপ থাকলে তারা হুমায়ূন আহমেদ পড়তেন, তাদের মন ভালো হয়ে যেত। এই যে পাঠকের মনের জায়গা করে নেয়ার বিরল ভাগ্য তা এত বিপুলভাবে বাংলাদেশে হুমায়ূন ছাড়া আর কারো তেমন হয় নাই। বাংলায় আমরা দেখি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এতটা বা তারচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। মাঝে একবার ভারতের কলকাতা থেকে সমরেশ মজুমদার ঢাকায় এসে বললেন হুমায়ূনের কথা। তার পাঠকপ্রিয়তায় বিস্ময় জানালেন। আসলেই, হুমায়ূন কেন এত পাঠকপ্রিয় হলেন?
হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য শুরু করেন সত্তরের দশকে। তবে তার জনপ্রিয়তার শুরু আরো পরে। নব্বই দশকজুড়ে এবং তারও পরে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যে রাজত্ব করেছেন বলতে গেলে। তার ‘হিমু’ চরিত্র একটি ট্রেন্ড হয়ে ওঠে। তার চরিত্রগুলো এখনো পাঠকদের মুখে মুখে। এটাই লেখকের স্বার্থকতা যে তিনি নিজের কাল্পনিক চরিত্রকে পাঠক সমাজে স্থাপন করতে পারেন। তিনি ‘গণ’ হতে পেরেছেন। এই গণ হয়ে উঠতে পারার পেছনে কী ক্যারিশমা কাজ করেছে আসলে?
আমরা যদি ভাবি যে বাংলাদেশের মানুষ আসলে কী পছন্দ করেন, সাহিত্যের অর্থে; এখানে প্রেম ও পারিবারিক কাহিনীর জনপ্রিয়তা বেশি। আশির দশক থেকে আমজাদ হোসেনের হাত ধরে বাংলা নাটক যেগুলো বিটিভি দেখাতে শুরু করে সেগুলোও পারিবারিক। জনপ্রিয় সাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটলে সেসবের প্রমাণ পাওয়া যাবে। কাসেম বিন আবুবাকার বা এমডি মুরাদও প্রেম, সম্পর্ক হওয়া-না হওয়া নিয়েই লিখেছেন।
বাংলা ভাষায় একটা সময়ে মানিক বন্দোপাধ্যায় বা তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়রা লিখেছেন সামন্তীয় সমাজ ভেঙে পুঁজিবাদের আসার ঘটনাবলি নিয়ে। সামন্তীয় সমাজে পরিবারের অবস্থা, তাদের সংকট এবং পুঁজিবাদ কীভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে-তাদের জীবনে সেসব নিয়ে। পুঁজিবাদে তাদের উপন্যাসের চরিত্ররা সমর্পিত হতে চাইছে না, তারপরও সেদিকেই যেতে হচ্ছে। তাদের পট বড়, সামাজিক প্রেক্ষাপট সেখানে বুঝা যায়। কমলকুমার মজুমদার কম পঠিত হলেও তিনি হিন্দু সমাজের বিশ্বাস, ভাঙা-গড়া, আধুনিক হতে না পারার সংকটকে দেখাতে চেয়েছেন। অমিয়ভূষণ মজুমদার আবার ইংরেজ শাসনামল এর প্রতিক্রিয়া, সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রভাব নিয়ে লিখেছেন। পরে সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা লিখেছেন পুঁজিবাদের সংকট নিয়ে। ষাটের দশকের বামপন্থী আন্দোলনের প্রভাব তাদের উপন্যাসে পাওয়া যায়।
হুমায়ূন আহমেদকে বুঝতে গিয়ে আমরা জেনেছি যে, সাহিত্য দুই ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর একটি হলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের অনুকূলে থেকে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য। আরেকটি হলো পাঠকের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য। আমি যখন স্কুল-কলেজে থাকতে শরৎচন্দ্র পড়তাম, তখন দেখতাম তার বইয়ের পেছনে একটা কথা লেখা থাকত। সেটা অনেকটা এরকম যে, পাঠকই পারে লেখককে স্বাধীনতা দিতে। সেই স্বাধীনতা হুমায়ূন আহমেদ কীভাবে অর্জন করলেন সে আলাপই বলতে গেলে এ লেখার মূল উদ্দেশ্য।
আমরা যদি বাংলা উপন্যাসের শুরুটা দেখি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। বা তারো আগে প্যারিচাঁদ মিত্রের গদ্য আখ্যান ‘হুতুম পেঁচার নকশা’, ‘আলালের ঘরের দুলাল’ লেখা হয়েছিল রাজনৈতিক বা সামাজিক অবস্থাকে তুলে ধরে। তারা সমাজকে জাগাতে, সমাজে নীপিড়িত শ্রেণির কষ্ট তুলে ধরতে অথবা জাতির ভবিষ্যৎ স্কেচ করতে চেয়েছেন।
অথচ বাংলাদেশের সাহিত্যে সেসব নাই, এ সাহিত্য ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল কেন? অনুমান করা যায় কয়েকটি কারণে।এর একটি হতে পারে এমন যে, এই ভূ-খÐে এত রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘেটেছে যে মূল ধারার যে শ্রেণি, অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণি তা নিজের মধ্যে ধারণ করতে সক্ষম হয় নাই। মুক্তিযুদ্ধের মতো বড় ঘটনার ক্ষেত্রেও সেটা দেখা যাবে। বিশেষ করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মধ্যবিত্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে অনেক কিছুই রাখতে পারে নাই। তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানে নিজেকে কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নাই। এখানে সেই অর্থে কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি সম্ভব হয় নাই। এ ছাড়া এখানে স্থানীয় বুর্জোয় শ্রেণির উপস্থিতিও চোখে পড়ে না। যখন পূর্ব পাকিস্তান হয়, তখন অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুব করুণ। মুক্তিযুদ্ধের পরও রাজনৈতিক হানাহানি, হত্যা, অস্থিরতার ভেতর কুলিয়ে উঠতে পারে নাই মধ্যবিত্ত। এখানে মধ্যবিত্ত নিজেকে চিনে উঠতে পারে নাই ও আশপাশকে জানা-বুঝার জন্য যে শিল্প তার মাধ্যম হয়ে কাজ করতে পারত, তারও বিকাশ পরিলক্ষিত হয় না।
মুক্তিযুদ্ধের পর রাজনৈতিক তীব্র অনিশ্চয়তা থিতিয়ে আসে নব্বিইয়ের দশকে। তবে তার আগে থেকে মধ্যবিত্ত টেলিভিশন, ভিসিআর ইত্যাদি টেকনোলজি মারফত যেসব শিল্প-বিনোদন উপভোগ করেছে তার বেশিরভাগই ছিল বাইরের। হয় ইংরেজী বা হিন্দি। বাংলা সিনেমা একটা ধারাবাহিকতা তৈরি করতে পারলেও পরে তা নষ্ট হয়ে যায়। ইতিমধ্যে করাপশনসহ বিভিন্ন বেআইনি কাজকারবার স্বাভাবিক হয়ে উঠতে থাকে। চাকরি-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অনিয়ম দুর্নীতির ছায়া বিস্তৃত হয়। আর্থিক সংকট থেকে মধ্যবিত্ত আশি-নব্বইয়ের দিকে বেরিয়ে আসলেও তারা রিক্রিয়েশনের জন্য বইকে খুব কমই পছন্দ করতে পারে। বাংলা সিনেমার পর টেলিভিশন নাটক আর পরে স্যাটেলাইটের যুগে এসে বৈশ্বিক বিনোদনের ভোক্তা হয়ে ওঠে তারা। বেচা এবং কেনা অর্থনীতির মধ্যবিত্ত তারা। এখানে শিল্প-কারখানা তৈরি হয়নি। নিজেদের প্রোডাক্ট বলে তেমন কিছু ছিল না।
এই ভোক্তা মানসিকতাই এখনকার মধ্যবিত্তের প্রধান স্বভাব। সফল ক্রিয়েটর হয়ে উঠতে তাদের খুব একটা দেখা যায় নাই। দেশে অর্থনীতি বিকশিত হয়ে উঠেছে যেসব খাতে যেমন রেমিট্যান্স, পোশাক বা বিভিন্ন প্রোডাক্ট বিক্রি-এর কোনোটা মধ্যবিত্তের জন্য উপযুক্ত ছিল না। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হতো খুব কম। বেসরকারি খাত ছিল অপ্রতুল। সবমিলিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বুদ্ধি-বিবেচনার জন্য এই মধ্যবিত্ত খুব কমই প্রস্তুত ছিল বলতে গেলে। স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, পরে যুদ্ধাপরাধ নিয়ে গণআদালতের আন্দোলনে কেউ কেউ অংশ নিলেও ক্ষমতা কখনো মধ্যবিত্তের হাতে ধরা দেয় নাই। বরং লুটেরা শ্রেণিই এখানে আধিপত্য ধরে রাখে। এ কারণে হয়তো রাজনৈতিক বা সামাজিক বিষয়াবলি নিয়ে লেখা সাহিত্যের পাঠক হয়ে উঠতে তার অনীহা দেখা যায়। এখানকার পাঠকের ঠিক এই ‘অ্যাপেটাইট’ বা রুচিকে ধরতে পারেন হুমায়ূন আহমেদ।
অপরদিকে এখানে ‘সাহিত্য করার’ জন্য ভারি ভারি, জটিল বিষয়গুলোকে বেছে নেয়া হতো। রাশিয়ান অনুবাদ সাহিত্যের প্রভাবে বামপন্থী দায়িত্বশীল লেখালেখির একটা প্রভাব ছিল। যেগুলো পড়তে কঠিন লাগে দেখে মধ্যবিত্ত গণহারে গ্রহণ করতে পারে নাই।
উল্টো দিকে হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় হলেও তার সাহিত্যে ‘দায়িত্বশীলতার’ বিষয় কম ছিল। মানে ঢাকাকে, ঢাকার পরিবর্তন তার লেখায় পাওয়া যায় না। তিনি যা লিখেছেন, নাটকেও, সাহিত্যেও তা হলো পারিবারিক কাহিনি মূলত। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম দুই উপন্যাস ‘শক্সখনীল কারাগার’ ও ‘নন্দিত নরকে’র কাহিনী যদি আমরা স্মরণ করতে পারি তাহলে দেখব সেখানেও পারিবারিক কাহিনীই আছে। এ দুই উপন্যাসে এমন কিছু বিষয় আছে যা তাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবার সুযোগ করে দেয়। যেমন নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যে যে ব্যবধান, সামাজিক টনাপড়েন, আবেগে ও উচ্ছ্বাসে অমিল, মধ্যবিত্তের দুর্বলতা- এসব পাওয়া যায়। নন্দিত নরকে উপন্যাসে আমরা দেখি রাবেয়া অন্তঃসত্ত্বা হয় এবং মারা যায়। এরপর তার ভাই মন্টু রাবেয়ার অন্তঃসত্ত্বা হওয়া এবং তার মৃত্যুর জন্য তাদের বাবার বন্ধু শরীফ মিয়াকে খুন করে। পরে মন্টুর ফাঁসি হয়। বোনের ইজ্জতের দায়িত্ব যে ভাইয়ের- প্রচলিত সামাজিক রিচুয়াল এখানে আমরা পাই। পাশাপাশি সত্তরের দশকের নিম্নবিত্ত পরিবারের সংকটের গল্পও এ উপন্যাসে আছে। শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসও একই। দুটো উপন্যাসে মিল আছে। চরিত্রদেরও যোগযোগ আছে। দুটো একই সময়ে লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ।
তার প্রথম প্রকাশিত বই নন্দিত নরকে বিক্রি হচ্ছিল না। বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা ঘুরে ঘুরে সে বই বিক্রি করেছিলেন। তিনি হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে বিরাট প্রতিভা দেখতে পেয়েছিলেন। পরে আবার হুমায়ূন আহমেদকে ‘চানাচুর’ লেখকও বলেছেন। হুমায়ূন ও আহমদ ছফাকে নিয়ে তার স্মৃতিকথা লিখেছেন। ধারণা করা হয় তার সৃষ্ট ‘হিমু’ আহমদ ছফা আসলে। কারণ ছফা শুধু হাঁটতেন। হুমায়ূন তার পা থেকে স্যান্ডেলটা খুলে দিয়েছেন শুধু।
হুমায়ূন আহমেদ তার একাধিক লেখায় বলেছিলেন যে, তিনি এ কৌশলে সাহিত্য করেন। অর্থাৎ এই যে স্যান্ডেলটা খুলে ফেলা, পকেট না থাকা, অথবা কারো কপালে তৃতীয় চোখ দেখা দেওয়ার মধ্য দিয়ে আসলে গল্প শুরু হয়। খুব সহজ আর ছোট কিছু দিয়ে গল্প শুরুর এ কৌশল ‘সিরিয়াস’ সাহিত্যে দেখা যেত না। তারা বড় বড় ঘটনা, কাব্য- এসব বিবেচনায় নিয়ে সাহিত্য লিখতেন।
হুমায়ূন আহমেদ যেমন তার অনেক উপন্যাসেই লিখেছেন যে, একজন মুরুব্বী অপেক্ষাকৃত তরুণকে ডাক দিলেন। তখন সেই তরুণ ‘জি¦’ না বলে ‘হুম’ বলে উত্তর দিল। মুরুব্বী তখন তরুণকে শাসান যে ‘হুম নয়, জি বলো’। তরুণটি তখন ‘জি’ বলে। এসব ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। সেই ঘটনাই যে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে তা এখানে হুমায়ূন আহমেদের আগে বোধহয় কেউ ভাবে নাই। তবে প্রশ্ন হলো এসব ঘটনাই কি সাহিত্যের মূল?
উপন্যাস বা সাহিত্যের কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, লক্ষ্য বা মূল থাকতে হবে এমন কোনো বিধি-বিধান নাই। তারপরও যখন কোনো উপন্যাস পড়া শেষ হয়, তখন আমরা (পাঠকরা) বিচার করি যে এ থেকে কী পেলাম। এতে দেখা যায়, হুমায়ূন আহমেদ পাঠককে বিনোদন বা সাময়িক আনন্দের বাইরে কিছু দেওয়ার দায়িত্ব নেন নাই। এর ফলে তার বই বিক্রি বেড়েছে অনেক। তবে ওপরে যে আলোচনাটা করলাম, ক্ষমতা বা সৃষ্টিশীলতা অর্জনের প্রশ্নে তার পাঠকরা নাজুক হয়েছে। আমরা দেখি যে তার পাঠকদের ভূমিকা থাকে না সমাজে। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও জটিল বা ঘোলাটে জিনিস ডিল করতেন না। সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়াবলি নিয়ে তাকে লিখতে দেখা যেত না তেমন। যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার ‘জোছনা ও জননীর’ গল্প উপন্যাসটি শোনা যায় অনেকে তাকে বার বার বলার পর লিখেছিলেন। তাও সেই উপন্যাস তার নিজেরই বিভিন্ন জায়গায় বারে বারে বলে যাওয়া কাহিনী। বড় কোনো প্রেক্ষাপট তাতে হাজির ছিল না।
হুমায়ূন লিখতে শুরু করেছেন এমন সময়ে এসে যখন রাশান বা অন্য ইউরোপীয় লেখকদের অনুবাদ বাংলায় এসে হাজির। সাহিত্যকে বড় বা বিস্তৃত ও জটিল পরিসর করে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টায় মশগুল লেখকরা। তারো আগে বাংলা সাহিত্যে কার্ল মাক্স বা সিগমুন্ড ফ্রয়েডে আচ্ছন্ন লেখকরা। গোবালাইজেশনের ঢেউয়ে বিভ্রান্ত ব্যক্তি ও সমাজ। সমাজ ভাঙছে, ব্যক্তি আক্রান্ত হচ্ছে, প্রভাবিত হচ্ছে। স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে দুনিয়া। সেসব মহাযজ্ঞ থেকে নিজেকে একেবারে সরিয়ে নিয়ে হুমায়ূন লিখছেন হিমুকে নিয়। তার পায়ে স্যান্ডেল নেই, পাঞ্জাবিতে পকেট নেই, তার সমস্যার নাম খালাতো ভাইয়ের গলায় মাছের কাঁটা আটকে গেছে।
এসব বৈশ্বিক রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ, বাণিজ্যিক আয়োজনের বিষয়গুলো বুঝে উঠতে আমাদের দেশের নাগরিকরা একেবারে প্রস্তু ছিল না। নব্বইয়ের দশকে তখন বাইরের পুঁজিবাদ এখানে সাংস্কৃতিকভাবে টেলিভিশনের মাধ্যমে দরজা-জানলা দিয়ে ঢুকে পড়তে শুরু করেছে। তখন একইসঙ্গে হিমু এখানকার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে প্রিয় হয়ে উঠছে। হুমায়ূনের হিমু পাঠক গোষ্ঠীকে আরো ‘ঘরকুনো’ করছে। দেশে তখন সবে ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ শুরু হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে শোরগোল চলছে। ব্যক্তি মানুষের জীবনে জলের মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে বৈশ্বিক ভোগবাদ। দেশে অর্থনৈতিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতার নতুন নতুন প্রপঞ্চ শুরু হয়েছে। হুমায়ূনের পাঠকরা তখন নিভৃতে কোনো প্রেম, আবেগের টানাপড়েনের কাহিনীতে বিভোর হয়ে আছে। নব্বইয়ের খোলাবাজারে তার বইও আরেকটা ‘পণ্য’ হয়ে উঠেছে।
হুমায়ূন আহমেদ আবার ব্যক্তিজীবনকে তার পাঠকের সামনে আনতে চান নাই। মানে তার কোনো চরিত্র নিজের মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করেন না, আকৃষ্ট হন না বলে আমি যতদূর পড়েছি, বুঝেছি। অন্য অনেক লেখকই আমাদের বাংলাদেশের তাদের আড্ডা, স্মৃতি, ঢাকা শহরকে নিয়ে লিখেছেন। হুমায়ূন সেসব বিতর্কে মোটেও যেতে চান নাই। তার নুহাশ পলী বা ধানমন্ডির আড্ডাগুলো তার কাছ থেকে কখনো জানা হয় নাই পাঠকের। তিনি কখনো সমাজ ভাঙতে চান নাই।
তিনি মূলত এন্টি-ইন্টেলেকচুয়াল ধারায় সাহিত্য চর্চা করেছেন। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে, ভাবকে তিনি উপহাস করেছেন। আমাদের দেশে এটা একটা ট্রেন্ড। এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা হয়। বুদ্ধিবৃত্তিকে সাফল্য বলে মানা হয় না। ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়ে ক্ষমতায় যে আছে তাকে পরিহাস কারাটাই যেন মুখ্য। হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্যে এসবই রেখেছেন আর জনপ্রিয় হয়েছেন। তিনি কিছু কিছু পারভারসনকেও প্রশ্রয় দিয়েছেন। ঘটনা বা নাম ধরে আলোচনা করে আগ্রহীদের সেসব বুঝিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি রেখেই কথাগুলো বলছি। পারভারসন বা বিকৃতি মানুষের সহজাত। অনেকেই অজান্তে তা উপভোগ করেন। বুঝতেও পারেন না এর সমস্যাটা কোথায়।
আমরা সহজ অর্থে জানি, সাহিত্যের কাজ হলো সংকটকে ডিল করা। সংকটকে কেন্দ্র করে কাহিনি এগিয়ে চলে। মনস্তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক, সামাজিক কোনো সংকটকে বুঝাপড়ার নিমিত্তে সাহিত্য তৈরি হয়- এই বুঝটাকে হুমায়ূন অস্বীকার করলেন। সদ্যপ্রয়াত ঔপন্যাসিক মিলান কুনেন্ডরাও অবশ্য এ ধরনের সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ সমালোচক। তার কাছে সাহিত্য মানে লেখকের মনের কথাকে কাগজে ফুটিয়ে তোলা। তার সাহিত্যও ‘সংকটমুক্ত’। হুমায়ূন আহমেদও তা-ই করেছেন। ওনার শুরুর দুই উপন্যাসে যে দারিদ্র্য, অর্থকষ্ট, আবছায়া ঘর, জানালা-পরের দিকে সেসব আর পাওয়া যায় না।
তিনি নিজেও বলেছেন প্রয়োজনীয় বা জরুরি লেখক হওয়ার বিষয়ে তার অনীহার কথা। এটাও বলেছিলেন তার সাহিত্য কিশোর উপযোগীদের জন্য। পরিণত বয়স্ক কেউ তার সাহিত্য পড়লে তিনি হবেন বোকা!
নিজের অভ্যাস থেকে হুমায়ূন আহমেদ বের হতে যে চান নাই তা কিন্তু না। তার শেষ দিকের একাধিক খন্ডের ‘মধ্যাহ্ন’ পড়লে মনে হয় তিনি এই ভূখন্ডকে ধরার চেষ্টা করতে চেয়েছেন। এমনিতে কথাসাহিত্যে হুমায়ূন কলকাতার আধিপত্যকে খর্ব করতে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন বলতে হয়। বাংলা সাহিত্যে ‘বাঙালি মুসলমান’ চরিত্র তিনি সৃষ্টি করতে চেয়েছেন সচেতনভাবে। কলকাতার ভাষার আধিপত্যকে ট্যাকল করেছেন। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মন, মানসিকতা, তাদের অবিকশিত চিন্তা ও রুচির বিষয়গুলো তিনি খুব ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন। হাসি-মশকরাময় চরিত্রদের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যে সেগুলো উপস্থাপন করেছিলেন।