মুহাম্মদ জাবেদ হোছাইন
ইসলাম শুধু একটি ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা এবং একটি সুসংগঠিত সভ্যতার নাম। এ সভ্যতার প্রতিটি স্তম্ভই গঠিত হয়েছে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে এবং তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিস্তৃত হয়ে নির্মাণ করেছে এক বিস্ময়কর ইসলামি তাহযিব-তামাদ্দুন বা সংস্কৃতি-সভ্যতা। এই সভ্যতা কেবল পাথরের মিনার, শিল্পকলা বা স্থাপত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর অন্তরভাগে রয়েছে সময়চেতনা, আত্মশুদ্ধি, ঐতিহাসিক উপলব্ধি ও নৈতিক চেতনার একটি উজ্জ্বল রেখাচিত্র। সেই প্রেক্ষাপটে হিজরি সন এবং হিজরি নববর্ষ ইসলামি জীবনের ক্যালেন্ডারিক কাঠামোর বাইরেও একটি সাংস্কৃতিক ও আত্মিক পরম্পরার প্রতীক।
হিজরি সনের সূচনা ছিল একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনার স্মারক। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় দীর্ঘ তেরো বছর অত্যাচার-নির্যাতনের পর আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় হিজরত করলেন, তখন সেটি কেবল একটি স্থানচ্যুতি ছিল না; বরং একটি নতুন সভ্যতার সূচনা, একটি নবজাগরণের বিপ্লব এবং সত্যের জন্য ত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) সাহাবায়ে কেরামের পরামর্শক্রমে হিজরতের ঘটনাকেই ইসলামি বর্ষপঞ্জির সূচনাবিন্দু হিসেবে নির্ধারণ করেন এবং মহররম মাসকে প্রথম মাস ঘোষণা করেন। এ সিদ্ধান্ত ছিল সময়কে একটি নৈতিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর এক অভিনব পদক্ষেপ।
ইসলামে হিজরি নববর্ষ উদযাপন ঘিরে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত বা আনুষ্ঠানিকতা নির্ধারিত না থাকলেও এর অন্তর্নিহিত অর্থ ও ব্যঞ্জনা অত্যন্ত গভীর। এটি এমন একটি উপলক্ষ, যা আত্মসমালোচনা ও আত্মজিজ্ঞাসার এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দেয়। নববর্ষ মানে কেবল সময়ের পাতা উল্টে যাওয়া নয়; বরং এটি হতে পারে নিজেকে নতুন করে গঠনের, অতীতের ভুল-ত্রুটি শুধরে ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হওয়ার এক পবিত্র প্রেরণা। মহররম মাস নিজেই চারটি সম্মানিত মাসের অন্তর্ভুক্ত; যেখানে পাপ থেকে বিরত থাকা, আত্মসংযম এবং শান্তি বজায় রাখার বিষয়ে কোরআন ও হাদিসে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ইসলামি তাহযিব-তামাদ্দুনে সময় ও বর্ষপঞ্জি ব্যবস্থাপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা নিছক তারিখ গণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় বহন করে। হিজরি সনের সঙ্গে মুসলমানদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতগুলো জড়িত যেমন রমজানের রোজা, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা, হজ, আশুরা ইত্যাদি। এসব উপলক্ষে হিজরি সনের ভূমিকা অপরিহার্য। তাই হিজরি নববর্ষ মুসলমানদের জীবনচক্রে সময়ের এক অনন্য মানদন্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা ধর্মীয় দিক থেকে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি ঐতিহাসিক ও সামাজিক দিক থেকেও অনস্বীকার্য।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমানরা হিজরি নববর্ষকে বিভিন্নভাবে স্মরণ ও পালন করে থাকেন। কোথাও এ উপলক্ষে পরিবারভিত্তিক মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়, কোথাও ইসলামি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, আবার কোথাও স্কুল-কলেজে আলোচনা সভা ও কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। অনেকে এই দিনটিকে ব্যক্তিগতভাবে কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ও তওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে কাটান। যদিও এসব অনুশীলন ফরজ বা সুন্নত নয়, তবুও এগুলো একটি ধর্মীয় পরিবেশ গড়ে তোলে এবং মুসলিম সমাজে আত্মিক আবহ সঞ্চার করে।
হিজরি নববর্ষ আমাদের ইতিহাস-চেতনার জাগরণ ঘটায়। নববর্ষ আসা মানে কেবল সময়ের হিসাব নেওয়া নয়; বরং এটি একটি আত্মজিজ্ঞাসার সময়—গত এক বছর আমি কতটুকু আল্লাহর বিধান মান্য করেছি, কতটুকু মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছি, কতটুকু আত্মশুদ্ধির পথে অগ্রসর হয়েছি। এই প্রশ্নগুলো প্রতিটি মুসলমানকে অন্তর্মুখী করে তোলে এবং এক নতুন আত্মদায়িত্বের অনুভব জাগিয়ে তোলে। নববর্ষ তাই আত্মশুদ্ধির দিক থেকেও এক গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হয়ে উঠতে পারে।
ইসলামি সাহিত্য বিশেষত আরবি, ফারসি ও উর্দু সাহিত্যে হিজরি নববর্ষ একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। বহু খ্যাতনামা আলেম, চিন্তাবিদ, কবি ও লেখক এই নববর্ষের গুরুত্ব তুলে ধরে কাব্য, প্রবন্ধ, খুতবা ও নসিহত রচনা করেছেন। সেখানে হিজরতের ইতিহাস, ত্যাগ ও আদর্শিক দৃঢ়তার কথা বলা হয়েছে। এসব সাহিত্যিক উপস্থাপনা ইসলামি সংস্কৃতির ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে এবং নববর্ষকে কেবল একটি সময়ের সূচনা নয়, বরং একটি নৈতিক জাগরণের বার্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আধুনিক বিশ্বে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের সর্বব্যাপী উপস্থিতি আমাদের অনেকটা আত্মপরিচয়হীন করে তুলছে। অনেক মুসলিম পরিবার, প্রতিষ্ঠান এমনকি সরকারও হিজরি সন ভুলে যেতে বসেছে। অথচ হিজরি সন মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। যদি আমরা হিজরি সনের চর্চা থেকে সরে যাই, তবে আমরা আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় পরম্পরা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। তাই হিজরি নববর্ষ পুনরায় চিন্তা ও চর্চার কেন্দ্রে আনা অপরিহার্য।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিজরি সন এবং নববর্ষ সম্পর্কে আলোচনা করা হলে ছাত্রছাত্রীরা ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হতে পারবে। পাঠ্যসূচিতে হিজরত, সাহাবায়ে কেরামের ত্যাগ, ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রবর্তন এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এভাবে তরুণ প্রজন্ম হিজরি নববর্ষকে শুধু একটি তারিখ নয়, বরং আত্মশুদ্ধির ও আত্মপরিচয়ের বাহক হিসেবে উপলব্ধি করতে শিখবে।
মিডিয়া এই নববর্ষকে কেন্দ্র করে একটি ইতিবাচক ও প্রেরণাদায়ী আবহ তৈরি করতে পারে। হিজরি নববর্ষ নিয়ে আলোচনামূলক অনুষ্ঠান, প্রামাণ্যচিত্র, সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা কিংবা সংক্ষিপ্ত ভিডিও প্রকাশ করে সমাজে নববর্ষ সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা সম্ভব। এভাবে নববর্ষ হবে সমাজের আধ্যাত্মিক ও চিন্তাশীল স্তরের এক মহৎ উপলক্ষ।
আলেম সমাজ, ইসলামি চিন্তাবিদ ও দা‘ঈ সম্প্রদায়ের প্রতি এ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্ব বর্তায়। কারণ তাঁরা হলেন উম্মাহর আত্মিক দিশারি, যাঁরা কেবল শরিয়তের মাসআলা নয়, বরং আত্মিক চেতনার প্রজ্বলন ঘটাতে পারেন। হিজরি নববর্ষ উপলক্ষে তাঁদের উচিত সাধারণ মানুষের মাঝে এই দিনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, হিজরতের প্রকৃত তাৎপর্য এবং নববর্ষকে কেন্দ্র করে কিভাবে একটি আত্মশুদ্ধির বিপ্লব ঘটানো যায়, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া।
মিম্বর-মেহরাব থেকে শুরু করে মিডিয়া, ইসলামি কেন্দ্র, মসজিদ ও মাদ্রাসায় তারা যদি নববর্ষকে উপলক্ষ করে তাওবা, তাক্ওয়া, ইখলাস ও দায়িত্বশীলতার বার্তা ছড়িয়ে দেয়, তাহলে মুসলিম সমাজ এক নবজাগরণমুখর ধারা লাভ করবে। আলেমগণ অতীতের সাহাবায়ে কেরামের ত্যাগ ও চেতনার বাস্তব শিক্ষা তুলে ধরে বর্তমান প্রজন্মকে আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করতে পারেন, যা আজকের বিভ্রান্ত ও নৈরাশ্যগ্রস্ত সমাজে খুব প্রয়োজনীয়।
হিজরি নববর্ষ কেবল একটি ধর্মীয় স্মারক নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর সামষ্টিক চেতনার প্রতীক। একটি অভিন্ন ক্যালেন্ডার মুসলমানদের মধ্যে ঐতিহাসিক সংযোগ তৈরি করে। হিজরি সনের প্রতিটি মাস, প্রতিটি তারিখ কোনো না কোনোভাবে ইসলামের ইতিহাস, ত্যাগ, বিজয় কিংবা শিক্ষা বহন করে। ফলে এই বর্ষপঞ্জি মুসলমানদের শুধু ইবাদতের সূচক নয়, বরং এক অভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিচয়পত্রও বটে। আজ যখন গোটা মুসলিম বিশ্ব ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বিভক্ত, তখন হিজরি সনের অভিন্ন স্মৃতিরেখা মুসলমানদের মাঝে ন্যূনতম ঐক্যের সেতুবন্ধন রচনা করতে পারে।
আমরা যদি হিজরি নববর্ষকে কেন্দ্র করে একটি সম্মিলিত শিক্ষা, স্মরণ ও চেতনার মঞ্চ তৈরি করতে পারি, তাহলে সেটা উম্মাহর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ঐতিহ্যচেতনা ও আত্মপরিচয়ের বোধকে আরও দৃঢ় করবে। এটা হতে পারে ইসলামের নামে বিভক্ত নানা মতাদর্শ ও বিভাজনকে অতিক্রম করে একটি ন্যূনতম ঐতিহাসিক সম্মিলন রচনার সেতুবন্ধ।
হিজরি নববর্ষ আমাদের সামনে এমন একটি আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধির দরজা খুলে দেয়, যা সামষ্টিকভাবে মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের ভিত্তি হতে পারে। প্রতিটি নববর্ষ যেন হয় নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার এক প্রতীজ্ঞার দিন। গত বছরের ভুল, পাপ, অলসতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ভুলে গিয়ে যেন আমরা হিজরতের প্রকৃত মর্মবাণী নিজ জীবনে বাস্তবায়নের শপথ গ্রহণ করি। এ নববর্ষ যেন হয় আত্মপ্রত্যয়ের, আত্মসংযমের এবং আল্লাহর দিকে ফিরে আসার দিন। যদি আমরা ব্যক্তি ও সমাজের স্তরে এই চেতনা জাগ্রত করতে পারি, তাহলে হিজরি নববর্ষ হবে কেবল দিনপঞ্জির পৃষ্ঠা নয়, বরং ইসলামি তাহযিব-তামাদ্দুনের হৃদয়ে প্রবাহিত এক জীবনঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ধারা।
লেখক : ব্যাংকার,কলামিস্ট