হাটহাজারী প্রতিনিধি
গত বৃহস্পতিবার (২৯ মে) ছিল অমাবস্যা তিথি’র দ্বিতীয় জো’র শেষ দিন। মধ্যরাতে প্রচন্ড বৈরী আওহাওয়ার মধ্যেই মেঘের গর্জন, বজ্রপাত, অতি ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলের স্রোতে বিশ্বের অন্যতম জোয়ার-ভাটার মিঠাপানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ প্রজাতির মা মাছ। প্রায় দুই মাস ধরে ডিম সংগ্রকারীদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত মা-মাছ পুরোদমে ডিম ছেড়েছে গতকাল শুক্রবার। নদীতে অপেক্ষমান ৫০০-৬০০ ডিম সংগ্রহকারী ইতোমধ্যেই মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহে নেমে পড়েছেন। যদিও এর আগে অন্তত দুই দফা নমুনা ডিম ছেড়েছিল মা মাছ। তবে তা খুবই নগন্য ছিল।
গতকাল শুক্রবার বিকেল ৫ টার দিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে মৎস্য অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্স ল্যাবরেটরি এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। এবার হালদা নদীতে মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কেজি।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আনুমানিক ২ টার দিকে প্রকৃতির এই বৈরি আবহাওয়ায় পুরনো ঐতিহ্যকে ধারণ করে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার অংশে অবস্থিত হালদা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে মা-মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। মা-মাছ ডিম ছাড়ার আগ মুহূর্ত থেকে নদীতে অবস্থানরত ডিম সংগ্রহকারীরা মা-মাছের ডিম ছাড়ার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে হাঁকডাক শুরু করেন। এ সময় নদীতে অপেক্ষারত প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ডিম সংগ্রহকারী ৩৫০-৪০০টি নৌকা, জাল ও পাতিলসহ নানা সরঞ্জাম নিয়ে উৎসবমূখর পরিবেশে মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের উৎসবে মেতে উঠেন।
তবে, গতকাল শুক্রবার ভোর রাতের দিকে আবহাওয়া বৈরি হওয়ায় স্বাভাবিক ডিম সংগ্রহে কিছুটা বিঘœ ঘটে। এরপরও এবার বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ভালো পরিমাণ ডিম সংগৃহ সম্ভব হবে বলে ধারণা হালদা গবেষকদের।
সরেজমিনে ঘুরে এবং ডিম সংগ্রহকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক ২টা থেকে হালদা নদীর মদুনাঘাট ছায়ারচর থেকে রামদাস মুন্সিরহাট, আমতুয়া, নাপিতার ঘোনা, আজিমের ঘাট, মাছুয়াঘোনা, কাগতিয়া, সিপাহী ঘাট, নয়াহাট, পুরালিয়া ¯øুইসগেট, কেরামতালির বাক এবং অঙ্কুরীঘোনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করতে পেরে অনেক ডিম সংগ্রহকারীরা খুবই খুশি। এই ডিম সংগ্রহ কার্যক্রম শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত চলে। এ সময় প্রতি নৌকায় ৩-১২ বালতি (৮-১০ লিটার পরিমাপের বালতি) পর্যন্ত মা-মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেছেন। দেখা গেছে, প্রতি নৌকায় সর্বনিম্ন ৩/৪, সর্বোচ্চ ১০/১২ এবং গড়ে ৭/৮ বালতি ডিম সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি বলে জানান ডিম সংগ্রহকারীরা।
হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে হালদা নদীতে মা-মাছ ডিম ছাড়েনি। তবে, তিন/চার বারের নমুনা ডিমের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৮০ কেজি। তার আগের বছর ২০২৩ সালে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি। তাছাড়া ২০২২ সালে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি, ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। ২০২০ সালে হালদা নদীতে রেকর্ড পরিমাণ ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৯ সালে প্রায় সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে স্থানীয়রা ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। এর আগে ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।
ডিম সংগ্রকরীরা জানিয়েছেন, চৈত্র মাসের শেষার্ধ থেকে হালদা পাড়ের জেলেরা জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে অপেক্ষার পর ডিম সংগ্রহের উৎসবে মেতে উঠেন। গত বৃহস্পতিবার অমাবস্যার শেষে আকাশে বজ্রপাত আর সঙ্গে শুরু হয় মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ। এর মধ্যেই হালদায় নামে পাহাড়ি ঢল। তারপরেই মা মাছ ডিম ছাড়ে। তবে, প্রচন্ড বৈরী আবহাওয়ার কারণে কিছু এলাকায় ডিম সংগ্রহকারীরা প্রত্যাশিত পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করতে পারেননি।
হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা নয়াহাট এলাকার বংশ পরম্পরায় অভিজ্ঞ প্রবীণ ডিম সংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন সওদাগর বলেন, সারা বছর আমরা এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করি। ভালো ডিম সংগ্রহ হয়েছে এবার। বিশেষ করে কাগতিয়া, সিপাহী ঘাট, নয়াহাট, পুরালিয়া স্লুইসগেট ও কেরামত আলীর বাকসহ আরও ২/৩টি এলাকায় ডিম সংগ্রহকারীরা প্রত্যাশিত পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করেছেন। এবার আমি নিজেই ১০টি নৌকায় প্রায় ৩৫-৩৭ বালতির মত মডিম সংগ্রহ করেছি। এবার প্রচুর ডিম সংগ্রহ করতে পারায় আমরা বেশ খুশি।
তিনি আরও জানান, বংশ পরম্পরায় অভিজ্ঞ ডিম সংগ্রহকারীরা মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করে সরকারি হ্যাচারি, মাটি ও সিমেন্টের কুয়ায় এসব ডিম থেকে রেনু ফোটাবেন। চার দিন পর রেণু ফুটবে। নিবিড় পরিচর্যা করতে হবে এখন। তারপর নির্দিষ্ট সময় শেষে পোনা বিক্রি হবে। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া এসব রেণুর পোনা দ্রæত বড় হয় বলে সারাদেশের মাছচাষিদের প্রথম পছন্দ। তাই দামও অনেকাংশে বেশি।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন আজাদী জানান, নদীর পারে স্থাপিত সরকারি ও বেসরকারি হ্যাচারী এবং ট্রেডিশনাল মাটির কুয়াগুলোতে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিমের পরিস্ফুটনে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। নদীতে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নৌ-পুলিশ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি যৌথভাবে ডিম সংগ্রহের তথ্যসংগ্রহ এবং নদীর সার্বিক পরিবেশ মনিটরিং করছে। রাতভর ডিম সংগ্রহ করে সকালে ডিম সংগ্রহকারীরা সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমগুলো হ্যাচারিতে নিয়ে আসেন। সেখানে কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক উপায় ১৮ ঘণ্টা পর ডিম থেকে রেণু হবে। তারা তিনদিন ধরে রেণুগুলোকে নার্সিং করবেন। এরপর পোনায় পরিণত হবে সেগুলো। অর্থাৎ সংগ্রহের ৯৬ ঘণ্টা পর মা মাছের ডিম বিক্রয়যোগ্য পোনায় পরিণত হবে।
অন্যদিকে, ডিম ছাড়ার পর ক্লান্ত মা মাছগুলো যাতে কেউ শিকার করতে না পারে এবং কৃত্রিম রেণু বিক্রেতারা যাতে সক্রিয় হতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করেছে বলে জানান হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ বি এম মশিউজ্জামান। তিনি বলেন, হালদাকে আগের রূপে ফেরাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গত এক বছরে হালদার মা মাছ রক্ষা করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে ড্রেজার, ঘেরা ও ভাসা জাল, বড়শি, বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহার করা নৌকা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হালদা পুরনো রূপ ফিরে পাচ্ছে। প্রচন্ড বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে ডিম সংগ্রহকারীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছেন। এতে ডিম সংগ্রহকারীর পাশাপাশি স্থানীয়রা খুশি এবং আমরাও খুশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরীর সমন্বয়ক হালদা গবেষক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, বহুল প্রত্যাশিত হালদা নদীতে রুই জাতীয় মা মাছ ডিম ছেড়েছে। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় দুইটা থেকে স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম সংগ্রহ শুরু করে। আমরা হালদা নদীতে মা মাছের ডিম সংগ্রহ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছি। এবার বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভালো পরিমাণে ডিম সংগ্রহ হয়েছে। আমি মনে করি, আজকের ডিম প্রাপ্তি হালদা নদী রক্ষায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনার একটি ফসল। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর, এনজিও আইডিএফ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সমন্বিতভাবে নিরলসভাবে কাজ করছে হালদা নদী রক্ষায়। হালদা নদী বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনার একটি সফল উদাহরণ।
তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে সরকার সাতটি বিভাগের আটটি নদীকে শতভাগ দখল ও দূষণমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে হালদা নদীকে শতভাগ দখল ও দূষণমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হালদা বাংলাদেশের একমাত্র নদী যেখানে নদীর ৬০-৭০% ভাগ ইতোমধ্যেই দূষণমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। ভূজপুর রাবার ডেম নিয়ন্ত্রণ, মানিকছড়ির তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ, পোল্ট্রি বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ এবং কাটাখালি কৃষ্ণ খালি এবং খন্দকিয়া খালের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে শতভাগ দূষণমুক্ত করা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি জেলার বাটনাতলী পাহাড় থেকে নেমে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার প্রায় ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে আছে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। এটি বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটা নদী যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পূর্ণিমায় প্রবল বর্ষণ আর মেঘের গর্জনের পর পাহাড়ি ঢল নামলে হালদা নদীতে মা-মাছ ডিম ছেড়ে আসছে।