বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র আমাদের এ নগরীর পাশে বয়ে যাওয়া হালদা নদী। এ নদীকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহই নয় শুধু, বিশ্বেও প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মৎস্যপ্রজনন নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের আগ্রহ ও গভীর দৃষ্টি রয়েছে এ নদীর প্রতি। দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহে, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের খেরোখাতায় যে নদীর ঠাঁয়, তাকেই চরম অবহেলা ও উপেক্ষায় ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের মানুষরূপী লোভাতুর দানবরা। এ নদীর দুই ধারে একসময় সবুজ অরণ্য, বৃক্ষরাজি আর জেলে ও কৃষকদের সারি সারি বাড়ি ছিল। যারা এ নদীর শান্তনীলাবে চাঁদনীর জ্যোৎ¯œা দেখতেন। আজ সেইসব মানুষের আবাসে গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা। এসব শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের স্তুপ ও কারখানার দূষিত পানি ফেলা হচ্ছে মৎস প্রজননের এ স্বচ্ছ জলে। তাতে নদীর পানি দিনের পর দিন দূষিত হচ্ছে, সেই সাথে বিলুপ্ত হচ্ছে নানা প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। হালদার এ বিবর্ণ রূপ দেখে গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও হালদার মাছে যাদের জীবন চলে তাদের আর্তনাদের অন্ত নেই। সরকারের কাছে কত হাজারো মিনতি তাদের। কিন্তু কার কথা কে শুনে?
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্য চাহিদা পুরণে শত শত বছর ধরে হালদার এই প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যবাহী মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের নাম হালদা। হালদা নদী প্রবাহের প্রাকৃতিক পরিবেশগত নিরাপত্তা বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ ও কৃষি অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে গণ্য। লক্ষ লক্ষ টন মৎস্য সম্পদ এবং হাজার হাজার মৎস্যচাষির ভাগ্য এই হালদার প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নির্ভর করছে। অতএব হালদার যেকোনো বিপদের আশঙ্কা দেশের মৎস্য সম্পদ তথা জাতীয় অর্থনীতির জন্যই বিপর্যয় হিসেবে গণ্য করা হবে। এ কারণেই হালদা নদী দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসে। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে অস্বাভাবিক দূষণ ও দখলে হালদার প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের অস্তিত্ব ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। সেই সাথে হালদার দূষণ রোধসহ এর নিরাপত্তায় সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের পাশাপাশি পরিবেশবাদী, বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজকেও যথেষ্ট সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে। তবে একের পর এক নানাবিধ বিপর্যয় ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যেন হালদার পিছু ছাড়ছেনা। একদিকে অপরিকল্পিতভাবে হালদার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার দূষণ ও দখলে বিপর্যস্ত অন্যদিকে হালদায় যান্ত্রিক ও নৌযান ও ট্রলার চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রায়শই ট্রলারের পাখার আঘাতে ডিমওয়ালা মা মাছের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গতকাল দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, মদুনা ঘাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত এলাকায় যেসব শিল্পকারখানা রয়েছে তার সবকটি শিল্পের বর্জ্য হালদার শাখা খাল বা ড্রেন দিয়ে হালদায় চলে আসে তাতে ব্যাপক আকারে দোষণের কবলে পড়ছে হারদার পানি। ফলে দেখা যায়, বর্ষা মৌসুমে মা মাছের ডিম ছাড়ার সময় সমাগত হলেও এ সময়ে নদীর এখানে সেখানে প্রায়শ মা মাছ মরে ভেসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব মৃত মাছের কোনো কোনোটা শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে মরে যাচ্ছে, আবার কোন কোনটি নদীতে চলমান ট্রলারের পাখায় বা বডিতে ধাক্কা লেগে মৃত্যু হচ্ছে। পানি দূষণ এবং ইঞ্জিনচালিত নৌকার পাখার আঘাতের পাশাপাশি মাছের ডিম ছাড়ার সময়ে গরমের দাবদাহ, প্রত্যাশিত বৃষ্টি না হওয়ার কারণেও হিটস্ট্রোকে মা মাছের মৃত্যুর আশঙ্কা করেছেন মৎস্য বিভাগের কোনো কোনো কর্মকর্তা।
সূত্র জানায়, হালদার পানিতে অক্সিজেনের পরিমান স্বাভাবিক প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম এবং অ্যামোনিয়ার পরিমান অস্বাভাবিক হারে বেশি। হালদার আশপাশের খালগুলোতে এ হার আরো অনেক বেশী। হালদা নদীর তীরে এবং আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠা কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য হালদায় গিয়ে পড়ার কারণে মা মাছের জীবনচক্র বিপর্যস্ত করে তুলেছে। হালদা নদীর দূষণে মাছ মরে ভেসে উঠার ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় জেলে ও মৎস্য বিশেষজ্ঞরা মৎস্য খাতের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন। ইতিমধ্যে কয়েকটি কারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও হালদার প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ ও পানির গুণাগুণ রক্ষায় যা যা করণীয় তার সবই করতে হবে। প্রয়োজনে সেখানকার আশপাশের সব কলকারখান সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। হালদা নদী ও খালের সাথে সংযুক্ত যেসব কলকারখানা সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয় সেসব কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ইটিপি বাস্তবায়নে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।