পূর্বদেশ ডেস্ক
মাঠ ঠেকাতেই গলদঘর্ম নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকারের। প্রতিদিনই কোনও না কোনও অস্থির পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে। রাজপথের আন্দোলন সংগ্রাম নিরসনে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। অবশ্য কৌশলগত কারণে সরকার সংঘাত-সংঘর্ষ মোকাবিলায় ‘নমনীয় নীতিতে’ চললেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হার্ডলাইনে যাওয়ার কথা ভাবছে। সরকার ছাত্রদের বিষয়ে নমনীয় অবস্থানে থাকার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করলেও অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে কারও ইন্ধন থাকলে কঠোর হস্তে দমনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের তিন দিনের মাথায় ৮ আগস্ট নোবেল শান্তি বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকার গঠনের সপ্তাহখানেক পর থেকেই নানান দাবিতে একের পর এক বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের ঘটনা দেখা গেছে। আন্দোলনকারীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা প্রাঙ্গণে অবস্থানসহ সচিবালয়ের মতো সুরক্ষিত স্থাপনায়ও ঢুকে পড়ে। পরে সরকার বাধ্য হয়ে যমুনা ও সচিবালয় প্রাঙ্গণে ১৪৪ জারি করে। তবে, আন্দোলন কখনোই পুরোপুরি থামানো যায়নি। কখনও আনসার, কখনও প্যাডেলচালিত রিকশাচালক, কখনও ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক, কখনও গার্মেন্ট শ্রমিক, কখনও শিক্ষক-চিকিৎসক-নার্স, কখনও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের চাকরিজীবী, কখনও পল্লী বিদ্যুতের কর্মচারী, শিক্ষার্থী-নাট্যকর্মীসহ পেশাজীবীরা, আবার কখনও চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়েছেন ছাত্ররা। নানা দাবিকে ঘিরে কমবেশি প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে খন্ড খন্ড আন্দোলন। এ অবস্থায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে অন্য দিনগুলোতে আন্দোলন যেন রুটিনে পরিণত হয়েছে। কখনও কখনও ছুটির দিনেও রাজপথে নেমেছেন তারা।
সরকারের সাড়ে তিন মাসের বেশি মেয়াদে অঙ্গীভূত আনসার, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালি, সাত কলেজের শিক্ষার্থী, সোহরাওয়ার্দী, কবি নজরুল ও মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ পুরান ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টানা কয়েকদিনের আন্দোলন থামাতে খুবই বেগ পেতে হয়েছে। এসব আন্দোলন ঘিরে কখনও কখনও রাজপথ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাজনীতিকে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।
সরকারকে সবশেষ বড় আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়েছে সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের সূত্র ধরে। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ২৫ নভেম্বর ঢাকায় গ্রেপ্তার করার খবর প্রচারের পরপরই ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়। পরদিন চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণেও ব্যাপক হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওইদিন আদালত প্রাঙ্গণে একজন আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এদিকে চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র দফতর বিবৃতি দেয়। অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে তার পাল্টা জবাবও দেওয়া হয়। চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তারের সূত্র ধরে সৃষ্ট সহিংসতা কিছুটা প্রশমিত হলেও বৃহস্পতিবার গার্মেন্ট শ্রমিকদের একটি অংশ আশুলিয়া গাজীপুরে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন। এদিন সচিবালয়ে কর্মচারীরাও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এসব আন্দোলন সংগ্রামের বাইরে নতুন সরকার আসার পরপরই মোহাম্মদপুর, উত্তরাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে গণডাকাতির ঘটনাও ঘটে।
একের পর এক এই আন্দোলন বিক্ষোভকে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ ধরনের অস্থিরতা চলতে থাকলে সরকারের যে কর্মসূচিগুলো রয়েছে সেটা বাস্তবায়নে কিছুটা হলেও বেগ পেতে হবে তারা মনে করেন। তবে, দেশকে সঠিক ট্রাকে তুলতে হলে সংস্কারের বিকল্প নেই বলে অভিমত তাদের। অপরদিকে সরকারের দাবি, মানুষ আকাঙ্খা থেকে বিপ্লবোত্তর সরকারের কাছে দীর্ঘদিনের বঞ্চনার কথা প্রকাশ করছে। সরকার তাদের বিষয়ে ইতিবাচক। প্রতিটি দাবি-দাওয়ার কথা শুনে সমাধানের চেষ্টা করছেন।
চলমান আন্দোলন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ২৭ নভেম্বর এক বিবৃতিতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, জনগণের অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যু কাজে লাগিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে চক্রান্তের জাল বিছিয়েছে। জনগণের মনে অসহিষ্ণুতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তিনি শক্তহাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রতি আহবান জানান।
গত কয়েক মাসের সংঘাত, সংঘর্ষ, অস্থিরতা ও গণ-অভ্যুত্থানের মিত্রদের বিভক্তির দায় অন্তর্র্বর্তী সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেন আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দেশবাসী আশা করেছিল সব জায়গায় ধীরে ধীরে শান্তি ফিরবে। কিন্তু পতিত ফ্যাসিবাদের মদতপুষ্ট ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে অরাজকতা তৈরির জন্য বারবার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকার সেই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে কোনও আগাম পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
বাংলাদেশে গত কয়েকদিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়ানক অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, ‘আন্দোলনগুলো এক ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে, এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। এটা সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জও বটে। তবে এটাও ঠিক, একটি স্বৈরাচারী জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ নিজেদের মুক্ত মনে করছে। এজন্য যে যার জায়গা থেকে অধিকারের কথা বলছে। সরকারও তাদের ক্ষেত্রে সহনশীল আচরণ করছে। অতীতে এমনটা হলে তো দমন-পীড়নের মুখে পড়তে হতো।’
‘সংস্কারের বিকল্প নেই’ মন্তব্য করে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘সরকার যে সংস্কার কাজগুলো হাতে নিয়েছে, সেটা সত্যিই খুবই জরুরি। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের মাধ্যমে সরকার একটি জায়গায় রেখে যেতে পারলে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার সেটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে। সংস্কারগুলো হলে রাজনৈতিক সরকার চাইলেও আগের মতো ফ্যাসিস্ট হতে পারবে না।’ দেশের জনগণের সহায়তায় সরকার যে সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
গত ২৫ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্র্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘দেশে পরিকল্পিতভাবে একটা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। বিগত সরকার নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এই ইন্ধনের পেছনে কারা জড়িত তদন্ত করা হচ্ছে। যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে আর এ ধরনের ঘটনা সহ্য করা হবে না।’
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ তাদের দাবি নিয়ে যে মাঠে আসছেন, তা মোকাবিলায় সরকারকে সেই অর্থে কোনও বেগ পেতে হচ্ছে না এবং তাদের এই কর্মসূচি সরকারের চলমান সংস্কার কার্যক্রমে কোনও বাধা সৃষ্টি করছে না।’
‘বিপ্লবোত্তর এ সরকারের কাছে মানুষের আকাঙ্খা অনেক বেশি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত সাড়ে ১৫ বছরে বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার শিকার দেশের আপামর জনগণ কথা বলতে পারেনি। দেশে এ ধরনের গণ-অভ্যুত্থানের পরে মানুষ তাদের অতীতের বঞ্চনার কথা বলবে এটা অস্বাভাবিক নয়। দেশের মানুষ মনে করছে এই সরকার তাদের কথা শুনবে এবং বাস্তবতা হলো সরকার তাদের কথা শুনছে। আমরা সবসময় বলে আসছি, আপনারা এভাবে রাস্তায় না নেমে প্রতিনিধির মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। যৌক্তিক সব দাবি আমরা সাধ্যমতো পূরণের চেষ্টা করবো।’
আলোচনা করে সরকার ইতোমধ্যে অনেক সমস্যার সমাধান করেছে জানিয়ে শফিকুল আলম বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে কথা বলার পরে কিন্তু তারা আবার ফিরে যাচ্ছে। তারা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলেও সরকার সহনশীল আচরণ করছে। অতীতের সরকারের মতো রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ছুড়ে আন্দোলন দমন করা হচ্ছে না। আমরা এখনও আহবান জানাই, কোনও দাবি থাকলে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা বা দফতরের সঙ্গে আলোচনা করুন।’
তিনি বলেন, ‘চলমান এই আন্দোলন সংগ্রাম সরকারের সংস্কার কাজে মেজর কোনও ইম্প্যাক্ট ফেলছে না। স্বাভাবিক গতিতে সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।’