জলাধার, লেক, খাল-বিল দখল ও ভরাটের কারণে মাছ ধরার সুযোগ একেবারে সংকুচিত হয়ে এসেছে। এতে মাছ ধরার প্রতি আগ্রহও হারিয়ে ফেলছে মানুষ। একসময় মাছ ধরার জন্য উৎসবমুখর আয়োজন থাকলেও কালের বিবর্তনে সেটা বিলুপ্তপ্রায়। বর্ষাকালীন মৌসুমে কিছুটা মাছ ধরার প্রবণতা থাকলেও অন্য সময়ে এর ধারেকাছেও নেই মানুষ। ফলে মাছ ধরার মূল উপকরণ জাল এখন বিলুপ্ত হতে চলেছে। এ জাল গ্রামীণ সমাজে একটি ঐতিহ্যও বটে। গ্রামীণ জনপদের মানুষের এ জাল ফেলার শখ থাকলেও মানুষের ব্যস্ততার ভীড়ে এ প্রাচীন ঐতিহ্যটি হারিয়ে যেতে বসেছে। আবার গ্রাম-গঞ্জে পুকুর-জলাশয়ের সংখ্যাও দিন দিন হ্রাস পেতে চলেছে দখলবাজদের নানামুখী থাবায়। জালের ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার পেছনে এটা অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
গতকাল শুক্রবার লালদিঘী এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, আবহমান কাল থেকে বাংলার এ ভূখÐে মাছ ধরায় জাল ব্যবহার হয়ে আসছে। ঝাঁকিজালের মধ্যে বাটালি জাল, কই জাল, ছটকি জাল, দুঁই জালসহ হরেক রকম জালের চাহিদা ছিল বেশ। যদিও এখন আর আগের মতো খাল-বিল পুকুর নদী নালায় সে ধরনের মাছ নেই, যা কেবল ঝাঁকিজালেই ধরা পড়ত। জাল বোনায় দক্ষ করিগর কমে গেছে। বস্তুত কার্পাস তুলার সুতার উৎপাদন ক্রমে কমে যাওয়ায় ইদানিং হাতে বোনা ঝাঁকিজাল কেনাবেচা হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
অন্যদিকে মেশিনে তৈরি নাইলনের জালের ব্যবহার বেড়েছে। জাল দিয়ে মাছ ধরা যে সৌখিনতা, তাও কমে গেছে। তাই বলে মাছ ধরার এ পদ্ধতি একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। কমবেশি সারাদেশেই তা চালু আছে। এখনও নদী কিংবা খাল-পুকুরে মাঝে মধ্যে ঝাঁকিজালের ব্যবহার হচ্ছে, যা কেবলই মনে করিয়ে দেয় বাংলার সেই ঐতিহ্যের কথা।
নগরীর লালদিঘী এলাকায় একসময় জালের ব্যবসা জমজমাট থাকলেও বর্তমানে তা বিলুপ্তির পথে। ১০ বছর আগে যে হারে বেচাবিক্রি হতো বর্তমানে তার অর্ধেকও নাই বললেই চলে।
প্রবীণ জেলে মো. ফারুক আহম্মদ জানান, জালের মধ্যেও রয়েছে হরেক রকম ফের। যেমন আকারে ছোট-বড়। অর্থাৎ হাত দিয়ে মেপে জাল পরখ করা হয়। সাধারণত ঝাঁকিজাল নিচে তিন-চার হাত এবং সর্বোচ্চ দশ-বারো হাত লম্বা হয়। বড় জাল অর্থাৎ ১০-১২ হাত লম্বা জাল দিয়ে সবার পক্ষে খেও মারা সম্ভব নয়। এজন্য যথেষ্ট দক্ষতা এবং শারীরিক সক্ষমতার প্রয়োজন। জালের ফাঁসেও রয়েছে তারতম্য। ছোট মাছ ধরার জন্য ক্ষুদ্র ফাঁস। বড় মাছের জন্য বড় ফাঁস। ঝাঁকিজাল বোনা দেখে যতটা সহজ মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে তা বেশ কঠিন কাজ। বিশেষ করে জালের ফাঁসের গেরো বা গিঁট শক্ত করা নিপুণ কারিগরি কাজ। ফাঁসের গিঁট দুর্বল হলে তাতে মাছ মিলবে কম। গিঁট শক্ত হলে মাছ যেমন বেশি মিলবে, তেমনি জাল হবে
ঠেকসই। জাল কতটা ফুলের পাপড়ির মতো চারপাশে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়ে, সেটাও জাল বুনিয়েদের দক্ষতা প্রমাণ করে। জালের নিচে অর্থাৎ শেষ প্রান্তে এক ধরনের থলে থাকে। যা আঞ্চলিক ভাষায় ‘খই’ বলা হয়। এতে ছোট আকারের মাছ গিয়ে জমা হয়। ঝাঁকিজালে লোহার কাঠি বা সীসার গুলি ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এতে জালের ওজন বাড়ে। মাছ বেরিয়ে যেতে পারে না।
এদিকে বাজারে ফিটিং, নন ফিটিং, হাতের তৈরি এবং মেশিনের তৈরি জাল বিক্রি করতে দেখা গেছে। সেখানে হাতের তৈরি নন ফিটিং জাল ১ হাজার ২০০ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। হাতের তৈরি ফিটিং জাল ২ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত, মেশিনের তৈরি নন ফিটিং ৮০০ থেকে থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত এবং মেশিনের তৈরি ফিটিং জাল ১ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মানুষ দিনদিন ডিজিটালের দিকে ধাবিত হওয়ায় আগের ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। তারপরও মাছ শিকার করছে না, তা কিন্তু নয়। আমাদের ব্যবসা মৌসুমী ব্যবসা। বর্ষাকালে ব্যবসা হলেও অন্য সময়ে একটু ঠান্ডা থাকে। এমনকি বর্ষাকালে দৈনিক এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হলেও অন্য সময়ে ১০ হাজার টাকারও বিক্রি হয় না। আবার অনেক সময় বিক্রিও হয় না বলে জানান তারা।
মেসার্স এফ কবির স্টোরের মালিক মো. ইমরান বলেন, আগে হাতের তৈরি জাল বুনন হতো বলে বেশ মজবুত এবং টেকসই হতো। তবে এখন মেশিনের তৈরি জাল বের হওয়ার ফলে হাতের তৈরি জালের চাহিদা কমেছে। আগে গ্রাম-গঞ্জের গৃহিণীরা জাল বুননের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতেন। বর্তমানে মোবাইল, ইন্টারনেট, টেলিভিশন অর্থাৎ ডিজিটাল যুগে তারা জাল বুনেন না। তাই ওইসব জালও এখন অনেক কমে গেছে।
কীভাবে গ্রাম-গঞ্জ থেকে জাল সংগ্রহ করা হয় প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা হলাম তৃতীয় পার্টি। এখানে যারা জাল বুনন করবেন, অর্থাৎ, গৃহিণীরা হলেন প্রথম পার্টি। আর যারা বাড়িতে গিয়ে গিয়ে জাল ক্রয় করবেন, তারা হলেন দ্বিতীয় পার্টি। সর্বশেষ দ্বিতীয় পার্টিরা দোকানদারদের কাছে বিক্রি করলে আমাদের হাতে আসে।
আরেক ব্যবসায়ী মো. ফৌজুল কবির পূর্বদেশকে জানান, একটা সময়ে ঝাঁকিজাল কেবলমাত্র দেশীয় কার্পাস সুতা দিয়ে তৈরি হতো। এতে জাল টেকসই হতো। কিন্তু পরে বাজারে নাইলনের সুতা আসায় দেশিয় সুতার কদর কমে যায়।
প্রবীণদের মতে, ঝাঁকিজাল বোনা একটা সময়ে বহু মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস ছিল। ঝাঁকিজাল কেনাবেচাও অনেকের পেশা ছিল। একনাগারে চার-পাঁচ দিনে ৫-৭ হাত লম্বা ঝাঁকিজাল বোনা সম্ভব হয়। এভাবে অনেকে সারা বছর ঝাঁকিজাল বুনতো। কারও কারও ঝাঁকিজাল বোনা ছিল শখ। চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি সাপ্তাহিক হাটে ঝাঁকিজাল কেনাবেচার নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। যেখানে সারি সারি জাল ঝুলিয়ে রাখা হতো। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জাল কেনার জন্য হাটে যেত। কেবলমাত্র জাল কেনাবেচার জন্য এখনও অনেক সাপ্তাহিক হাট বিখ্যাত হয়ে আছে।











