হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘরের ঐতিহ্য

2

রতন কুমার তুরী

দূর অতীতে এক কিংবা দোতলা বিশিষ্ট মাটির ঘর ছিল গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্যময় বাড়ি। সাধারণত গ্রামের জমিদার কিংবা অবস্থাপন্ন পরিবার এ মাটির ঘর নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করতো। মুলতঃ মাটির ঘরগুলো নির্মানের জন্য একধরনের কারিগর ছিল। তারা দলবদ্ধ হয়ে বাড়ি বানানোর জন্য অর্ডার নিতো। কেউ কেউ কমপ্লিট মাটির ঘর তৈরি করে দেয়ার জন্য কাজ নিতো। আবার কেউকেউ দৈনিক হিসেবে মাটির ঘর তৈরির কাজ করতো। একসময় গ্রামীণ জনপদে গ্রামে গ্রামে মাটির ঘর দেখা যেতো। অনেক সময় মাটির ঘরগুলো বিভিন্ন কারুকাজ দিয়ে নির্মাণ করা হতো। যেগুলো দূর থেকে দেখতে পাকা দালানের মতো দেখাতো। প্রকৃতপক্ষে গ্রাম বাংলার চির ঐতিহ্যের নিদর্শন সবুজ শ্যামল ছায়া ঘেরা শান্তির নীড় মাটির ঘর। যা এক সময় গ্রামের মানুষের কাছে এসি ঘর নামে পরিচিত ছিলো। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের মাটির ঘর। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রামেও। মাটির ঘরের জায়গায় তৈরি হচ্ছে প্রাসাদসম অট্টালিকা। মাটির ঘরের স্থান দখল করে নিচ্ছে ইট-পাথরের দালান। একটু সুখের আশায় মানুষ কত কিছুই না করছে। তবুও মাটির ঘরের শান্তি ইট পাথরের দালান কোঠায় খুঁজে পাওয়া ভার।
মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, প্রযুক্তির উন্নয়ন, রুচিবোধের পরিবর্তন, পারিবারিক নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের সুরক্ষার কারণে এখন আর কেউ মাটির ঘরে থাকতে চান না। সচ্ছল মানুষেরা এখন ঝুঁকে পড়েছেন পাকা দালানের দিকে। তারপরও মানুষ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নগরায়ণের সাথে সাথে পাকা দালান কোঠা তৈরি করছেন। তাই আধুনিকতার ছায়ায় আর সময়ের পরিবর্তনে গ্রাম বাংলা থেকে ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি ঘর আজ প্রায় বিলুপ্তের পথে। বেশিদিন আগের কথা নয়, প্রতিটি গ্রামে একসময় মানুষের নজর কাড়তো সুন্দর এ মাটির ঘর। ঝড়, বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি প্রচুর গরম ও খুবই শীতে বসবাস উপযোগী মাটির তৈরি এসব ঘর এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। আধুনিকতার ছোঁয়া আর কালের বিবর্তনে বিভিন্ন গ্রামে এ চিরচেনা মাটির ঘর বিলুপ্তির পথে বললেই চলে। অতীতে মাটির ঘর গরিবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর বলে পরিচিত ছিল। এ ঘর শীত ও গরম মৌসুম আরামদায়ক তাই আরামের জন্য গ্রামের দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি অনেক বিত্তবান ও মাটির ঘর তৈরি করে থাকতেন।
জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই মাটির ঘরের প্রচলন ছিল। এটেল বা আঠালো মাটি কাঁদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হত। ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড়, টালি বা টিনের ছাউনি দেয়া হত। মাটির ঘর অনেক সময় দোতলা পর্যন্ত করা হতো। এসব মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের তিন-চার মাসের অধিক সময় লাগতো। গৃহিণীরা মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আল্পনা একে তাদের নিজ বসত ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তুলতেন। অনেক সময় অনেক জায়গায় মাটির ঘর তৈরির সময় একইসাথে একটা ছোটখাট পুকুরও খনন করে ফেলা হতো কারণ দু’তলা মাটির ঘর তৈরির জন্য প্রচুর মাটির প্রয়োজন হতো । এসব মাটি পুকুর থেকে তুলে নিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরন করে তারপর মাটির ঘরের দেয়ালে ব্যবহার করা হতো। মাটির ঘরের মুল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি গরমের দিনে বেশ শীতল অনুভব হয় আর ঠান্ডার দিনে অনেকটাই গরম এবং আরামদায়ক। এমন মাটির ঘর একসময় বাংলার প্রতিটি গ্রামে দেখা মিললেও বর্তমান আধুনিক সভ্যতার ইট পাথরের আড়ালে এটি হারিয়ে যেতে বসেছে। এখনও কিছুকিছু জায়গায় এর কিঞ্চিৎ দেখা মিললেও এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তেমন একটা আর কারিগর মেলেনা ফলে এগুলোও ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে। মাটির ঘরকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে নতুন রূপ না দিলে এটিও একদিন আমাদের সমাজ সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক