হারিয়ে যাওয়ার পথে এতিহ্যবাহী ট্রাম গাড়ি

4

রূপম চক্রবর্ত্তী

আমি বাংলাদেশে বাস করলেও ছোটকাল থেকে কলকাতার ট্রেনের সাথে পরচিত। কলকাতা গেলেই ট্রাম দেখার চেষ্টা করি। ট্রাম কলকাতার ঐতিহ্য এবং কলকাতার গর্ব দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটক ট্রাম দেখতে কলকাতায় আসেন। শিল্প-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বর্ণময় মেলবন্ধন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা। প্রাচীন এই শহরের আনাচকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে অজানা গল্প আর ইতিহাস। এই অজানা গল্পের সাথে ট্রামের ইতিহাসও লিপিবদ্ধ থাকবে। ট্রামের শেষ আসনে বসে খাওয়া বাদামভাজার খোলসের মাঝে কত সুখদুঃখ-হাসিকান্না জমে আছে, তার ইয়ত্তা নাই। গল্প-উপন্যাস, গান থেকে চলচ্চিত্রে কলকাতার ট্রামের উপস্থিতি উল্লেখ্য করার মতো।
তাই অনেকেই কৌতুহল নিয়ে শেষবারের মতো ট্রামে চড়ে ইতিহাসের সাক্ষী হতে চাইছেন। ফিওডর পিরোটস্ক এর আবিষ্কৃত কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ট্রামের ১৫০ বছর পূর্তি উৎসব হয় গত ২০২৩ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি।
কলকাতায় ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালানো হয়। ১৮৮৩ সালে কলকাতা-সহ ভারতের ১৫টা শহরে যাত্রা শুরু করেছিল ট্রাম। শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়া ঘাট পর্যন্ত ওই ট্রাম চলে। পরে ‘কলকাতা ট্রামওয়ে কোম্পানি লিমিটেড’ গঠন করা হয়। এ কোম্পানির নিবন্ধন ছিল লন্ডনে। প্রথম দিকে ঘোড়া টানা ট্রাম ব্যবহার করা হত। এই সময় ট্রাম কোম্পানির হাতে ১৭৭টি ট্রাম ও ১০০০ টি ঘোড়া ছিল। এক একটা ট্রাম টানবার জন্য ব্যবহার হত একজোড়া ওয়েলার ঘোড়া। এই ওয়েলার ঘোড়াগুলিকে নিয়ে আসা হত সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে। কলকাতার শ্যামপুকুর, চিৎপুর, শিয়ালদহ, ধর্মতলা, ভবানীপুর ও খিদিরপুরে প্রথম পর্যায়ে ট্রাম কোম্পানির ডিপো ও আস্তাবল তৈরি হয়েছিল। কলকাতার আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় ট্রাম ডিপো হল রাজাবাজার ও টালিগঞ্জ। সবচেয়ে পুরনো ট্রাম ডিপো খিদিরপুর, আয়তনে সবচেয়ে ছোট ডিপো হল কালীঘাট। ঘোড়ায় টানা ট্রামগুলি সাধারণত এক কামরার হত। তার কারণ একে দুটি ঘোড়ার সাহায্যে ট্রাম টানার কিছু অসুবিধা ছিল। তা ছাড়া ট্রাম বেলাইন হলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও ছিল। প্রতি বছরই গরমের সময়ে অতিরিক্ত খাটুনি সহ্য করতে না পেরে বেশ কিছু ঘোড়া মারা পড়ত।
পরে স্টিম ইঞ্জিন ব্যবহৃত হত ট্রাম চালানোর জন্য। ১৮৮২ সালে কর্পোরেশন ট্রাম কোম্পানিকে পরীক্ষামূলকভাবে বাষ্পীয় ইঞ্জিন ব্যবহার করে ট্রাম চালানোর অনুমতি দেন। ট্রামের চৌরঙ্গী লাইনে এই ট্রাম চলেছিল ১৮৮২ সালের মে মাস থেকে ১৮৮৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত। এর মধ্যেই রাস্তায় ট্রামের জন্য ছয়টি পথ দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়। এই সময় ট্রাম কোম্পানির ১৯ মাইল ট্রাম লাইন ছিল। ১৯০০ সালের শুরুতে ১৪৩৫ এমএম (৪ ফুট ৮.৫ ইঞ্চি) স্ট্যান্ডার্ড গেজের ট্রাম লাইন চালু হয়। ১৯০২ সালে ট্রাম পরিষেবার বৈদ্যুতীকরন শুরু হয়; যেটি ছিল এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা। স্বাধীনতার কিছু পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করে। বর্তমানে এটি ভারতের একমাত্র ট্রাম পরিসেবা। নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব এই পরিবহনটির সঙ্গে কলকাতার ঐতিহ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে রয়েছে। তাই দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছেও ট্রাম আর কলকাতা দুটো নামই প্রায় সমার্থক।
সান ডিয়াগো থেকে শুরু করে হংকং পর্যন্ত বিভিন্ন শহরের হালকা রেলকে নতুন করে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আর দূষণ এবং জনাকীর্ণতার সঙ্গে লড়াই করা কলকাতার মতো একটি শহরে শতবর্ষী পুরনো এই পরিবহন ব্যবস্থা মৃত প্রায়।
কলকাতার বহু ল্যান্ডমার্ক; সিনেমা হল, বইয়ের দোকান থেকে শুরু করে জাদুঘর কিংবা হাসপাতাল; এমন অনেক কিছু নির্মিত হয়েছিল ট্রাম চলাচলের রাস্তাকে ঘিরে। এসব স্থাপনার একটি ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দাস গুপ্ত বুকস।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের এই যুগে বৈদ্যুতিক লাইন দ্বারা চালিত নির্গমনমুক্ত ট্রাম ডিজেল-জ্বালানি চালিত বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ির চেয়ে একটি ভালো বিকল্প। ট্রামের সাথে যুক্ত চালক এবং পরিবহন শ্রমিকদের মানবতার পাশে কাজ করতেও দেখা গেছে। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা বাধলে এই সংস্থার কর্মচারীবৃন্দ হিন্দু-মুসলমান ঐক্য রক্ষায় গৌরবজনক ভূমিকা গ্রহণ করেন। কলকাতার সমস্ত ট্রাম শ্রমিকেরা একত্রিতভাবে রাজাবাজার ট্রাম ডিপোতে এসে উল্টোদিকের ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনের ছাত্রীদের রক্ষা করেন সশস্ত্র দাংগাবাজদের হাত হতে।
১৫০ বছর সময়কালে কলকাতার ট্রামে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে কালের নিয়মে গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে অনেক পিছিয়ে পড়ছে ট্রাম যাত্রা। কলকাতার মত ব্যস্ততম মহানগরে ট্রামের মতো এত ধীরগতির যান চালু রাখার বিপক্ষে অনেকেই মত প্রকাশ করেন। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই ট্রাম পরিষেবা চালু রাখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। আধুনিক কলকাতায় এত ধীর গতির যান একদম অনুপযুক্ত বলে অনেকের মত, যার ফলে অকারনে যানজটের সৃষ্টি হয়। কলকাতা ছাড়া বাকি সমস্ত শহরেই ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে ট্রাম চলা। দিন যত এগোচ্ছে তত নিত্যনতুন যানবাহন আসছে। জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে কলকাতার সড়কে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু, সড়ক চওড়া হয়নি। এই অবস্থায় সড়কের মাঝখান দিয়ে ট্রাম চলাচল আজকের দিনে অনেক কঠিন। এবার কলকাতার রাস্তায়ও একেবারে বন্ধের পথে ট্রাম। শুধু সাড়ে ৩ কিলোমিটার রাস্তায় ট্রাম চলবে বলেই জানা গেছে। শহরের স্মৃতি হিসেবে নির্দিষ্ট পথ দিয়ে চলাচল করবে একটি মাত্র ট্রাম। হেরিটেজ হিসেবে ধর্মতলা থেকে ময়দান পর্যন্ত যে ট্রামটি রাজ্য পরিবহন দফতর চালাতে চান ওই ট্রামেই চড়তে পারবেন আগ্রহীরা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট