
নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
১৯২১-এ বাংলাদেশের প্রথম ‘দৈনিক জ্যোতি’ প্রকাশের পর থেকে তারই কাঠামোকে ধারণ করে চট্টগ্রামে সাংবাদিকতা বিকশিত হয়। সাপ্তাহিকের অবদানও অস্বীকার করা যায় না। বরং সাপ্তাহিককেই চট্টগ্রামে সাংবাকিতার পথিকৃৎ বলতে হয়। কালীশংকর চক্রবর্তী, কাশীশ্বর গুপ্ত যখন চট্টগ্রামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে সাংবাদিকতার চর্চায় নিয়োজিত হন, তখন উনবিংশ শতাব্দী প্রস্থানোদ্যত সংশোধনী, পূর্ব প্রতিধ্বনি ইত্যাদি তাঁদের প্রকাশিত সংবাদপত্র। ‘অঞ্জলি’ নামে একটি সংবাদপত্রের কথাও মনে আসছে। কিন্তু সেটি কেই সময়ের সাময়িকী কিনা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। জ্যোতিও প্রথমে সাপ্তাহিকই ছিলো, জ্যোতি দৈনিক হওয়ার পূর্বে সাপ্তাহিক রূপে প্রকাশিত হতো।
রাজনৈতিক প্রয়োজনে জ্যোতি দৈনিক হয়েছিলো। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রাজনীতির একটি তুমুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী সময়। মহাত্মা গান্ধীর ‘এক মাসের মধ্যে স্বরাজ’ ঘোষণায় সে বছর সারা ভারতজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। কলকাতা স্পেশাল কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত নাগপুরে সমর্থিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকেই এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো। চট্টগ্রামে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ছিলেন দেশপ্রিয় জেএম সেনগুপ্ত ও চট্টলগৌরব মহিম চন্দ্র দাশ। অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে একটি পত্রিকার প্রয়োজন অনুভব করে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ কালীশংকর চক্রবর্তীর সাপ্তাহিক ‘জ্যোতি’ পত্রিকা তাঁর কাছ থেকে নিয়ে দৈনিকে রূপান্তরিত করেন। কংগ্রেস সম্পাদক মহিমচন্দ্র দাশ হন সম্পাদক।
সেসময় আরো দুটি ঘটনা ঘটেছিলো, যে ঘটনায় চট্টগ্রাম সমগ্র ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। একটি ঘটনা হচ্ছে বিওসি ধর্মঘট ও চাঁদপুরে আসামের চা বাগান শ্রমিকদের আন্দোলন। যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তকে সভাপতি পদে বৃত করে বিওসি শ্রমিক কর্মচারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে বিওসি শ্রমিক কর্মচারী অভ‚তপূর্ব ধর্মঘট পালন করে। চাঁদপুরের এ বি রেলওয়ের শ্রমিক ধর্মঘটেও নেতৃত্বে দেন জে এম সেন সেনগুপ্ত। অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার সব জেলার মধ্যে চট্টগ্রামের সাড়া এবং কর্মসাধনা এত বেশি ও বেশিষ্ট্যপূর্ণ ছিলো যে, মহাত্মা গান্ধী তাঁর ‘ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় চট্টগ্রামের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর স্বাক্ষরিত রচনায় বলেছিলেন, ‘Chittagong to the fore’ (12.1.1921) অর্থাৎ ‘সবার আগে চট্টগ্রাম’। ১৯২১-এ গান্ধীজী চট্টগ্রামে এসেছিলেনও।
সরকারের রোষানলে পতিত হয়ে জ্যোতির প্রকাশনা শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেলে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মহিম বাবু তাঁর সাপ্তাহিক ‘পাঞ্চজন্য’ পত্রিকাকে দৈনিক রূপান্তরিত করেন। চট্টগ্রামে দ্বিতীয় দৈনিকের জন্ম হলো। পাঞ্চজন্য-এর প্রথম সম্পাদক মহিম বাবু, পরে তাঁর ভাই অম্বিকাচরণ সম্পাদকতা করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন বলবৎ হওয়ার কালে একটি নির্বাচন হয়। চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান স্বনামধন্য নূর আহমদ এমএ, বিএল ঐ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তাঁর সমর্থনে জেলা মুসলিম লীগ সম্পাদক প্রখ্যাত ব্যবসায়ী আহমদ সাগীর চৌধুরী ‘আজান’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির সম্পাদক হন ফকীর আহমদ। নির্বাচনের পর ফকীর আহমদের চাকরি হয় চট্টগ্রাম পৌরসভায়। এই আজান আরো দু’বার প্রকাশিত হয়Ñ পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে এবং ষাটের দশকের শেষভাগে। পঞ্চাশে জয়নাল আবেদিন চৌধুরী সম্পাদক এবং ষাটের দশকে জয়নাল আবেদিন চৌধুরী ও হাবিবুর রহমান খান যৌথভাবে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। দু’বারই ফজলুল কাদের চৌধুরীর মানিকানায় আজান প্রকাশিত হয়। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে আহমদ সাগীর চৌধুরী ও ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন পরস্পরের প্রতিদ্ব›দ্বী। আহমদ সাগীর চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী ফজলুল কাদের চৌধুরী কিভাবে আজান’র মালিক হয়ে গেলেন তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর পূর্বে জমানা সম্পাদক এবং ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমের চাচাত ভাই কবি আবদুস ছালাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে একটি দৈনিক প্রকাশ করেন। মাহবুব উল আলমের জমানা প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে।
রাজনৈতিক চেতনা যে সংবাদপত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিলো তা’ নিয়ে গবেষণা হতে পারে। ৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে পত্রিকার যে চরিত্র ছিলো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তা রাতারাতি পাল্টে যায়। তখন ছিলো সবকিছুতে ইসলামী লেবাস চাপিয়ে দেয়ার সময়। তবে দেশভাগ চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার জন্য লাভজনক হয়েছিলো। সেই সময় ভারত থেকে অপশন দিয়ে বেশ ক’জন সাংবাদিক চট্টগ্রামে এসেছিলেন। তারা মোহাজের সাংবাদিক নামে চিহ্নিত হন। তাঁরা উর্দুভাষী বলেও ইংরেজি সাংবাদিকতায় দক্ষ ছিলেন। ফলে তাঁদের উদ্যোগে ‘ইস্টার্ন এক্সামিনার’, ‘ক্রনিকল’, ‘ইউনিটি’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হতে দেখা যায়।
তবে চট্টগ্রামের সাংবাদিকতা বিশেষ করে বাংলা সাংবাদিকতা তখনই সাবালকত্ব অর্জন করে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর যখন দৈনিক আজাদী প্রকাশিত হয়। সাংবাদিকতায় প্রাতিষ্ঠানিকতা ও পেশাদারিতার মনোভাব তখনই আসে। আজাদীর প্রথম বার্তা সম্পাদক হন হাবিবুর রহমান খান নামে ত্রিশোর্ধ একজন যুবক। যিনি শিক্ষকতা ছেড়ে পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে সাংবাদিকতায় আসেন। ইংরেজি পত্রিকা দিয়ে তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের আরম্ভ। তাঁর প্রথম কর্মস্থল ছিলো ইস্টার্ন এক্সামিনার। সম্ভবত হাবিবুর রহমান খানই ছিলেন আজাদীতে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একমাত্র সাংবাদিক। আরো কেউ থাকতে পারেন, কিন্তু আমি তা জানতে পারিনি। ফলে আমার ধারণা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য আমি পাঠকদের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করি। ইঞ্জিনিয়ার খালেক যখন আজাদী প্রকাশ করেন, তখনো সাংবাদিকতা পেশার প্রতি মানুষের আগ্রহ বা আকর্ষণ তৈরি হয়নি। না হওয়ার কারণ সেটি কোনো অর্থকরী পেশা ছিলো না। সাংবাদিকরা যে বেতন পেতেন, তা’ দিয়ে সংসার চালানো কঠিন ছিলো, তাছাড়া চাকরির নিশ্চয়তাও ছিলো না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তখন স্কুল পাশ করে কলেজিয় শিক্ষার জন্য সমগ্র চট্টগ্রামে একটিই মাত্র কলেজ ছিলোÑ চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ। পাকিস্তান হওয়ার পরপর কলকাতা থেকে ভাগাভাগি করে এনে চট্টগ্রামে একটি কমার্স কলেজ স্থাপন করা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দু’বছর পর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সাতকানিয়ায় একটি কলেজ স্থাপিত হয়। পঞ্চাশে ইন্টারমিডিয়েট পাস তরুণ-যুবক তখনো হাতে গোণা কয়েকজন।
৬০ যখন পূর্ণ হয় এবং আজাদী বের হয়, তখন চট্টগ্রামে ইন্টার পাস ছাত্র যাঁরা সাংবাদিকতায় এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হাবিবুর রহমান খান, এপিপি-খ্যাত নুরুল ইসলাম (স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে প্রথমদিকে আজাদীতে কাজ করেন), সায়ফুল আলম, মঈনুল আলম, নজির আহমদ (১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ইস্টার্ন এক্সামিনারে যোগ দেন), শরীফ রাজা, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী (তমদ্দুন মজলিশের সাপ্তাহিক সৈনিক তাঁর প্রথম কর্মক্ষেত্র), বিএ আজাদ ইসলামাবাদী, পূর্বদেশ-খ্যাত নুরুল ইসলাম (পঞ্চাশের দশকে ইউনিটি প্রকাশিত হলে তিনি উক্ত পত্রিকায় যোগদান করেন) এবং বেলাল বেগ-এ ক’জনের নামই আমার জানা সম্ভব হয়েছে। হাবিবুর রহমান খান, শরীফ রাজা, বিএ আজাদ ইসলামাবাদী এবং সম্ভবত বেলাল বেগ আজাদীতে জয়েন করেন। বিএস আজাদ ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে আজাদীতে স্টাফ রিপোর্টার ও সাব-এডিটর হিসেব সাংবাদিকতা শুরু করেন। বেলাল বেগ প্রথমে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সাপ্তাহিক কোহিনূর এবং ৬০-এ আজাদী বের হলে সেখানে যোগদান করেন। অধ্যাপক খালেদ আসেন ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে এবং তাঁর বন্ধু সাধন কুমার ধর (১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে হাবিবুর রহখান খান আজাদী ছেড়ে দেয়ার পর সাধন বাবু হন বার্তা সম্পাদক) সাব এডিটর হন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে। ৬২-তে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের মৃত্যুর পর অধ্যাপক খালেদ আজাদীর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আরেকটি কথা বলা দরকার আজাদী যখন বের হয়, তখন একজন বিখ্যাত সাংবাদিক চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। তাঁর নাম ফজলুর রহমান। তিনি অবজারভারের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি ছিলেন। সম্ভবত রয়টার্সের পক্ষেও কাজ করতেন। তাঁর উদ্যোগে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব গঠিত হয়। ৬২’র ছাত্র আন্দোলনে তিনি ছিলেন ছাত্র নেতাদের মন্ত্রগুরু।
অতএব উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা ধরে নিতে পারি, আজাদীর মাধ্য্যমে চট্টগ্রামে সাংবাদিকতা আধুনিক যুগে পদার্পণ করেছিলো। হাবিবুর রহমানকে তার পুরোধা এবং তাঁর হাত ধরেই চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার উত্তরণ ঘটেছিলো আধুনিক পর্বে। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ নয়া বাংলা প্রকাশের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সাংবাদিকতায় দ্বিতীয় বিপ্লব (কম্পিউটারে কম্পোজ ও অফসেটে মুদ্রণ) সাধিত হলে সেই বিপ্লবেও নেতৃত্ব (নির্বাহী সম্পাদক) দেন হাবিবুর রহমান খান। সুতরাং চট্টগ্রামের সাংবাদিকতায় হাবিবুর রহমান খান ছিলেন একটি ইনস্টিটিউশন, একটি ইতিহাস এবং একজন নমস্য পুরুষ।
হাবিবুর রহমান খান কে বা কী ছিলেন? সহজ উত্তর – সাংবাদিক। কিন্তু এতে তাঁর সম্পূর্ণ পরিচয় জ্ঞাপন হয় না। তাহলে যদি বলি তিনি প্রথিতযশা, প্রখ্যাতনামা সাংবাদিক ছিলেন, তাতেই কী তিনি পূর্ণরূপে প্রকাশিত হন? না, মনে হয় এবারও তাঁর পরিচয় সম্পূর্ণ হলো না। তাহলে তিনি আর কী ছিলেন। সেটাই আমি বলার চেষ্টা করবো বক্ষ্যমান নিবন্ধে। কিন্তু আমি একজন ক্ষুদ্র নির্গুণ সাংবাদিক। তাঁর মাপের একজন বড়ো সাংবাদিক সম্পর্কে বলার যোগ্যতা কী আমার আছে? আমার সন্দেহ নিরসন হয় না।
হাবিবুর রহমান খান শুধু সাংবাদিক নন, সাংবাদিকতার একজন শিক্ষক ছিলেন। তেমন শিক্ষক চট্টগ্রামে আর একজন ছিলেন, তিনি সাধন কুমার ধর। দু’জনই আজাদীর সাংবাদিকÑ হাবিবুর রহমান খান আজাদীর প্রথম বার্তা সম্পাদক, সাধন বাবু তাঁর উত্তরসূরী। হাবিবুর রহমান খান আর একজন সাংবাদিক সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন, তিনি হচ্ছেন ওয়াহিদুল হক। তিনি ঢাকাতেই সাংবাদিকতা করতেন। কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রামে এসে আনোয়ারুল ইসলাম ববিকে ডেইলি লাইফ প্রকাশে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক, হাবিবুর রহমান খান বার্তা সম্পাদক। পরে আমি যখন তাঁর পত্রিকা সান্ধ্য দৈনিক ‘সেবক’-এ কাজ করছিলাম, তখন তিনি গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, ওয়াহিদুল হক সাহেব একজন জ্ঞানী সাংবাদিক, পÐিত মানুষ, ইংরেজি, বাংলাতে সমান দক্ষ ছিলেন। এমন ভাষাজ্ঞান সম্পন্ন সাংবাদিক দেশে কমই আছে। ওয়াহিদুল হক সাহেব সাংবাদিকতা ছাড়াও সংগীতগুণী, সাহিত্যিক, শিল্প-সংস্কৃতির সমঝদার হিসেবে সুখ্যাত ছিলেন।
এটা হাবিবুর রহমান খান সাহেবের উদারতা। তিনি নিজেও জ্ঞানী ছিলেন এবং আরেকজন জ্ঞানীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কুণ্ঠিত হতেন না। ওয়াহিদুল হক সাহেব ছিলেন বাম ঘরানার মানুষ, মার্কসবাদে বিশ্বাসী। হাবিবুর রহমান খান ছিলেন মধ্যপন্থী, কিছুটা রক্ষণশীল। তবুও বিপরীত আদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে তাঁর অসুবিধা হতো না।
হাবিবুর রহমান খানও বাংলার ন্যায় ইংরেজিও ভালো জানতেন। তিনি যেমন বাংলা পত্রিকায় (আজাদী, আজান, নয়া বাংলা, সেবক, সাপ্তাহিক সমাজ) সাংবাদিকতা করেছেন, তেমনি ইংরেজি পত্রিকায়ও (ইউনিটি, ইস্টার্ন এক্সমিনার) কাজ করেছেন। তিনি ইস্টার্ন এক্সমিনারের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। ইস্টার্ন এক্সামিনার তখন উঁচু মানের ইংরেজি দৈনিক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলো।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে নয়াবাংলায় যোগদানের পূর্বে এক সময়ে একটি ইংরেজি ম্যাগাজিনের জন্য তিনি কাজ করতেন। সেটি সম্ভবত ইলাস্ট্রেটেউ উইকলি অব বাংলাদেশ; সেই ম্যাগাজিনের জন্য তিনি শেফালী ঘোষের একটি ইন্টারভিউ নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন।
হাবিবুর রহমান খান আওয়ামী লীগ করতেন না। তবে আওয়ামী লীগের নিউজ ফলাও করে প্রকাশ করতেন। আওয়ামী লীগের নিউজ আসলে তিনি দেখতে চাইতেন এবং তার সম্পাদনা ও প্রকাশে বিশেষ যতœ নিতেন। আমাকে তিনি বলেছেন, এম এ আজিজ বহু সময় বিশেষ করে ৬৯ এবং তাঁর পরবর্তী নির্বাচনের সময়ে প্রেস রিলিজ পাঠাতে না পারলে টেলিফোন করে নিউজ দিতেন। তিনি তা গুরুত্ব সহকারে ছাপিয়ে দিতেন।
সাংবাদিকতার শিক্ষক প্রসঙ্গে আরো বলা যায়, বিগত দিনের (৪৭-পূর্ব ও পরবর্তী) কয়েকজন কিংবদন্তী সাংবাদিকদের নাম। তাঁদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, কাজী মোহাম্মদ ইদরিস, সিরাজউদ্দিন হোসেন, এস এম আলী, সন্তোষ গুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সার, বজলুর রহমান, এবিএম মূসা, কে জি মুস্তাফা, আবদুল আউয়াল খান প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
আমি জিয়ার আমলে শিল্পকলা একাডেমীর কোন অনুষ্ঠানে এদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলামিস্ট খোন্দকার আবদুল হামিদকে (তখন তিনি মন্ত্রী) বলতে শুনেছি, ‘আমি আবুল মনসুর আহমদের পদতলে বসে সাংবাদিকতার অ আ ক খ শিখেছি।’ আমিও বলতে চাই আমি হাবিবুর রহমান খানের পদতলে বসে সাংবাদিকতার অ আ ক খ শিখেছি।
হাটহাজারী নিবাসী প্রখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক আজাদীর সিনিয়র সাংবাদিক মরহুম মাহবুব-উল-আলম, দৈনিক পূর্বকোণ সম্পাদক বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অন্যতম কিংবদন্তী কে জি মুস্তাফা এবং বাংলার বাণী – খ্যাত মীর নুরুল ইসলামও সাংবাদিকতায় আমার অন্যতম শিক্ষাগুরু ও দীক্ষাগুরু।
চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার গৌরবময় সোনালী অতীতের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক হলেন হাবিবুর রহমান খান। তাঁকে ঐ সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকও যদি বলা হয় তাহলে অত্যুক্তি হবে না। শুধু ষাটের দশক নয়, ঊনিশ শতকের শেষদিকে চট্টগ্রামে সাংবাদিকতার সূচনা এবং বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষে দৈনিক পত্রিকার আরম্ভকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সেরা সাংবাদিকদের যদি কোনো তালিকা করা হয়, তাহলে হাবিুবর রহমান খান হেঁটে হেঁটে সেই তালিকায় ঢুকে যাবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, চট্টগ্রামের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সাংবাদিক অধুনা বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়ে গেছেন। তাঁর স্মরণে কোনো আলোচনা সভা হয় না, তাঁর জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী নীরবে পেরিয়ে যায়, তাঁকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় কোনো লেখা প্রকাশিত হয় না। তিনি নিজেও কিছু লিখে যাননি। তাঁর কোনো জীবনী গ্রন্থ নেই; চট্টগ্রাম চরিতাভিধান জাতীয় বেশ কিছু জীবনী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; তাতে কোথাও হাবিবুর রহমান খানের জীবনী সংকলিত হতে দেখিনি। যেসব কৃতবিদ্য মানুষের জীবনী এসব গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তিনি কী তাঁদের চে’ কোনো অংশে ন্যূন, হীন ছিলেন? হাবিবুর রহমান খানের প্রতি এই নিষ্ঠুর উপেক্ষা, নির্মম অবহেলা কী তাঁর প্রাপ্য ছিলো? চট্টগ্রামে সাংবাকিতার বিকাশে, মান উন্নয়নে তাঁর কী কোনো অবদানই ছিলো না? চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার জগত এখন অনেক বড়ো; চট্টগ্রামের পত্রিকা খুব বেশি না হলেও ঢাকার অনেক পত্রিকা, অনেক চ্যানেলের ব্যুরো অফিস চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়েছে, তাতে কাজ করেন এমন সাংবাদিকের সংখ্যা আমার তো মনে হয় দুশোর বেশি বৈ কম হবে না। তো’ সাংবাদিকতার এই প্রশস্ত রাজপথটা যাঁদের শ্রমে-ঘামে, মেধায়-মননে নির্মিত হয়েছে, আজকে অতীত খুঁজে যদি তাঁদের নামধাম ঠিকুজি উদ্ধার করা সম্ভব হয়, তাহলে হাবিবুর রহমান খানের নাম সেখানে বেশ ওপরের দিকেই পাওয়া যাবে। — চলবে
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক











