
নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
(গতকালের পর)
চট্টগ্রামের সাংবাদিকতাকে সাবালকত্বের পর্যায়ে উন্নীত করতে আরো অনেকের সঙ্গে হাবিবুর রহমান খান তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সাংবাদিকতার একটা উচ্চ মানদন্ড তিনি মনে পোষণ করতেন। সেই মানে উত্তরণের জন্য তিনি নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। দৈনিক ‘সেবক’ নামের এই পত্রিকাটি প্রথমে ছিলো সান্ধ্য দৈনিক; পাথরঘাটা ইকবাল রোডের মুখে সেন্ট প্লাসিডস স্কুল ও ক্যাথলিক ক্লাবের সীমানা ছাড়িয়ে সেন্ট স্কলাসটিকাকে হাতের বাঁয়ে রেখে সোজা পূর্বদিকে ফিশারি ঘাটের দিকে যে রাস্তাটি চলে গেছে, সেটির নাম ইকবাল রোড। তারই মুখে ‘ক্রান্তি প্রিন্টার্স’ নামক একটি প্রেস থেকে হাবিবুর রহমান খান সান্ধ্য দৈনিকটি বের করেছিলেন। আমার বন্ধু, সহপাঠী ও আত্মীয় বিনিনেহারার কামাল ছিলো এই ছাপাখানার ম্যানেজার। তখন পত্রিকার ডিক্লারেশন নিতে তেমন টাকা-পয়সা খরচ হতো না। হাবিবুর রহমান খান চিরদিনই দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে ছিলেন। আর্থিক অনটনের মধ্যে জীবন যাপন করেও তিনি অতৃপ্ত ছিলেন না। তাঁর আর্থিক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে একটি সুখী পরিবারের সুখী জীবনের স্বাদ গ্রহণে তিনি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু নীতি বিসর্জন দিয়ে, আদর্শের সঙ্গে আপস করে জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁর অনুজ মুজিবর রহমান খান গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে চাকরি করতেন, তাঁরই সঙ্গে থাকতেন। পরিবারের ব্যয় নির্বাহে এই ছোট ভাইয়ের উপার্জন কিছু কাজে আসতো।
যা-ই হোক, সান্ধ্য দৈনিক সেবক-এর ডিক্লারেশন নিলেন বটে হাবিবুর রহমান খান, কিন্তু পত্রিকার খরচ জোগানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি তাঁর ছিলো না। ফলে অনিল বাবু নামে বোয়ালখালী থানার জ্যেষ্ঠপুরার একজন মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী অংশিদারী চুক্তিতে তাঁর পত্রিকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসলেন। ক্রান্তি প্রিন্টার্স থেকে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে পত্রিকা প্রকাশ আরম্ভ হলো। তিনি ছিলেন প্রকাশক ও সম্পাদক। সাংবাদিক বলতে নোমান সাহেব (নয়া বাংলার প্রথম বার্তা সম্পাদক), আমি, বন্দরের রইসুল হক বাহার (পরে পূর্বকোণ, ডেইলি স্টার, সুপ্রভাত বাংলাদেশ-এ সুনামের সঙ্গে কাজ করেন), আনোয়ারা নিবাসী এমইএস কলেজের অধ্যাপক কাযী আযীয উদ্দিন আহমদ, মাইনুল হাসান চৌধুরী (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক), নারায়ণগঞ্জ নিবাসী তালাত মাহমুদ, বাঁশখালী নিবাসী ছৈয়দ আহমদ (নোমান সাহেবের ভায়রা), মিরসরাই নিবাসী সঞ্জীব।
১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ নভেম্বর হাবিবুর রহমান খান সান্ধ্য দৈনিক সেবককে প্রভাতী দৈনিকে রূপান্তরিত করেন। কালারপোল হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ও তাঁর বন্ধু নাসির আহমদের জামাতা মিরসরাই নিবাসী ব্যবসায়ী নুরুন্নবী সাহেব, তাঁর জ্ঞাতি ভ্রাতা প্রখ্যাত আয়কর আইনজীবী ওকন্যারা নিবাসী ওহাব সাহেব, শিকলবাহা ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আবদুল জলিল চৌধুরী (ঘাটফরহাদবেগের বাংলাদেশ প্রেসের স্বত্তাধিকারী) প্রমুখকে পর্যায়ক্রমে অংশিদার হিসেবে নিয়ে পত্রিকা চালাতে লাগলেন। পাথরঘাটার অ্যাডভোকেট কামালউদ্দিন আহমদ খানও সম্ভবত কোন সময় কোনভাবে সেবক প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। যাঁরা খান সাহেবের পার্টনার হয়েছিলেন, তাঁরা কেউ তেমন বড়লোক ছিলেন না। ফলে তাঁদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগ পত্রিকার বিশাল ব্যয় মেটাতে অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হলো। আস্তে আস্তে পত্রিকা সংকুচিত হতে হতে এক সময় অক্কা পেয়ে গেলো। তবে তার আগে সংবাদপত্র-যোদ্ধা হাবিবুর রহমান খান যে নিজেই সংবাপত্রের জন্য শহীদ হয়ে গিয়েছিলেন, সে কাহিনী যেমন মর্মান্তিক, তেমনি করুণ। সাংবাদিকতার শহীদ বললেই তাঁর প্রতি সুবিচার করা হয়। সংবাদপত্রকে ভালোবেসে কেউ নিজের জীবনকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত ওই একজন হাবিবুর রহমান খানই, দ্বিতীয় কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আমি অন্তত পাইনি। এক সময় তাঁর পত্রিকার প্রকাশনা অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলো, পার্টনাররাও একে একে ছিটকে পড়েন। শেষ পর্যন্ত শুধু নুরুন্নবী সাহেব ও জলিল চৌধুরী সাহেব ছিলেন। জলিল চৌধুরীর ‘বাংলাদেশ প্রেস’ থেকে প্রভাতী দৈনিক সেবক প্রকাশিত হতো। সেবক-এ আমি প্রথমে চিফ রিপোর্টার, পরে আমাকে বার্তা সম্পাদক করেছিলেন খান সাহেব। এ সময় জমানার মোস্তাক আহমদ (পরে ‘ছুটি’, ‘ইনকিলাব’ ও ‘আমাদের সময়’-এর ব্যুরো চিফ এবং বর্তমানে বাংলাদেশ অবজারভার-এর ব্যুরো চিফ) চিফ রিপোর্টার পদে যোগদান করেন। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা জামাল উদ্দিনও (বর্তমানে গবেষক, লেখক, চট্টলচিত্র নামে একটি সাময়িকীর সম্পাদক এবং বলাকা প্রকাশনী নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারী) আমাদের সঙ্গে কিছুদিন স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে দৈনিক সেবকে কাজ করেন। সিনিয়র সাংবাদিক ও ছড়াকার জহুর উর শহীদ সাহেবও কিছুদিন কাজ করেছিলেন। তিনি অনেক সিনিয়র মানুষ, আমার পিতার সঙ্গে লেখক সংগঠন করতেন। কালাম চৌধুরী বিজ্ঞাপনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সাতকানিয়ার চিববাড়ির রাজনীতিবিদ শিব্বির আহমদ সিদ্দিকী নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতেন। দেব প্রসাদ বড়ুয়া ছিলেন সংশোধনী বিভাগে (পরে বিখ্যাত স্পোর্টস রিপোর্টার)। বাসস থেকে নজির আহমদ ও নুরুল ইসলাম চৌধুরী, জেলা তথ্য কর্মকর্তা মোফাজ্জল সাহেব, আইএসপিআর থেকে খালেদ বেলাল সাহেব এবং আজাদী থেকে শরীফ রাজা সাহেব, মাহবুব উল আলম, কাজী জাফরুল ইসলাম ও ইউসুফ সাহেব, মরহুম আ.জ.ম ওমর যিনি পরে পূর্বকোণে আমার সহকর্মী হয়েছিলেন-এঁরা আসতেন। ওমর সাহেবকে দিয়ে বাসস’র দু’একটি কপিও অনুবাদ করিয়ে নিতেন খান সাহেব।
হাবিবুর রহমান খান সাহেব পত্রিকার জন্য কেমন নিবেদিত ও সংগ্রামী যোদ্ধা ছিলেন, তার একটা উদাহরণ দিই। পত্রিকার কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি টেবিলে শুয়ে একটু বিশ্রাম বা ঘুমিয়ে নিতেন। বাসায় যেতেন না। কোন কোনদিন অধিক রাত হয়ে গেলে বাসায় যাওয়া সম্ভব হতো না। টেবিলেই শরীরটা এলিয়ে দিয়ে রাত কাটিয়ে দিতেন। দিনের পর দিন এমন অনিয়ম, শরীরের ওপর অত্যাচার করতে করতে এক সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
একজন দক্ষ ও ভালো সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সুনাম এবং তাঁর নিপুণ সম্পাদনায় দৈনিক সেবক একটি উন্নতমানের সংবাদপত্র হিসেবে দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা ও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়ার মত তাঁর যৎসামান্য পুঁজি একটি দৈনিকের হাতির খোরাক জোগান দিতে গিয়ে প্রতিদিন হিমশিম খেতে খেতে অবশেষে একদিন আর্থিক দৈন্যদশার কাছে হোঁচট খেয়ে থেমে গিয়েছিল সেবকের অগ্রযাত্রা।
জীবনের সেই চরম সংকটকালে নানা প্রতিক‚লতা ও মানসিক আঘাতে তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এক সময় পরিবার নিয়ে শহরের বাসায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে তিনি গ্রামের পৈত্রিক বাড়িতে গিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নেন। আর্থিক অনিশ্চয়তা, মানসিক আঘাতে তাঁর শরীরে আগে থেকে বাসা বেঁধেছিল হৃদরোগ, মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্যে হৃদরোগের বাড়াবাড়ি শুরু হয়ে যায়। স্বপ্ন ছিল দেশকে একটি উন্নতমানের আধুনিক দৈনিক পত্রিকা উপহার দেবেন, আর্থিক টানাপড়েনে হেরে গিয়েছিল তাঁর স্বপ্ন; জীবনযুদ্ধেও হতমান ও হতাশার গ্লানিতে তখন তাঁর ভেঙে পড়ার মত অবস্থা। তবুও তাঁর মনোবল ছিল অটুট, একদিন জীবিকার তাগিদে ঢাকা চলে যান পরিবার পরিজনকে চট্টগ্রামে রেখে। চাকরিতে যোগদান করেন ইরান দূতাবাসের প্রেস সেকশনে। একই সাথে তিনি ঢাকার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জনকল্যাণ সংস্থা সেবার কাউন্সিলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অত্যন্ত দায়িত্ব সচেতন মানুষ ছিলেন, তাই মৃত্যুর কাছে ধরাশায়ী না হওয়া পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বগুলি পালন করে গেছেন। নিজের বিপর্যস্ত অবস্থাকেও কিছুটা কাটিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। রাতদিন পরিশ্রম এবং মানসিক উৎকণ্ঠার মধ্যে জীবনযাপন করতে করতে এক সময় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু ডাক্তারেরা যখন দেখলেনন, তাঁর বাঁচার সম্ভাবনা কম, তাই তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে তাঁর অঞ্চলের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করাতে পরামর্শ দেন তাঁরা। ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করানো হয় এবং ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন সকালে তিনি হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তাঁর প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান। আহা! কত বড় মাপের একজন সাংবাদিক কেমন নিঃস্ব, নিঃসহায় অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। কেউ জানলোনা, শুনলো না, তাঁর নিঃসাড় দেহটা টেবিলের ওপর ফেলে রাখা হয়েছিলো। পরে পরিবারে জানাজানি হলে তাঁরা এসে নিয়ে যান তাঁর মরদেহ। একটি সংবাদপত্রের জন্য যে মানুষটি প্রাণপাত করলেন, তাঁকে সংবাদপত্রের শহীদ ছাড়া আর কিই-বা বলা যায়। জান যায় কবুল, কিন্তু মান দেবো না অর্থাৎ প্রাণ গেলেও লড়াই থেকে পিছপা হন নি সাংবাদিক- যোদ্ধা হাবিবুর রহমান।
তিনি কী একটা চাকরি পেতেন না? তাঁর লেখাপড়ার যে উঁচু মান, তাতে অনায়াসে তিনি যেকোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কোনো উঁচু পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন। কিংবা কোনো সংবাদপত্রেও পরামর্শক কিংবা নির্বাহী সম্পাদক গোছের কোনো পদ যা’ তাঁর মর্যাদার সঙ্গে মানানসই হতো তা’ হতে পারতেন। অথবা প্রথম জীবনে যেমন শিক্ষকতা করেছিলেন, তেমনি আবার শিক্ষকতায়ও যোগ দিতে পারতেন। কিন্তু ওই যে একবার পত্রিকার সম্পাদক হয়েছেন, তার নিচে আর তাঁর পক্ষে নামা সম্ভব ছিলো না। তাঁর আত্মসম্মানবোধ কেমন প্রখর ছিলো তার একটা উদাহরণ দিই। সম্ভবত স্বাধীনতার বছর দু’আড়াই পর জাসদ নেতা আহমদ শরীফ মনীর গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাঁর মুক্তির দাবি জানিয়ে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেয়ার জন্য আমি সাংবাদিক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। হাবিবুর রহমান খান একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, সেজন্য বিবৃতিতে তাঁর একটি সই নেয়ার জন্য আমি তাঁর কাছে যাই। তিনি বিবৃতিতে তাঁর আগে কে কে সই করেছেন সেটা দেখলেন, তারপর আমাকে বললেন, নাতি, বিবৃতিতে আমি তো সই দিতে চেয়েছিলাম। তুমি এসেছ, তাছাড়া মনীর আমাদের এলাকার লোক। কিন্তু আমার জন্য মুস্কিল হয়েছে তোমরা এমন একজন সাংবাদিকের স্বাক্ষর ইতিমধ্যে নিয়েছ, যার নিচে সই করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমরা প্রটোকল বুঝতে পারো নি। আমি বুঝতে পারছি কার কতটুকু মর্যাদা তোমাদের তা’ জানা নেই। সাংবাদিক বা সম্পাদক শুনে তোমরা যার স্বাক্ষর নিয়েছো, তিনি কি মাপের সাংবাদিক এবং চট্টগ্রামের সাংবাদিক সমাজের মধ্যে তার অবস্থান কোথায়, সেটা জানলে নিশ্চয়ই তোমরা আগে তার স্বাক্ষর নিতে না। আমি সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, হাবিবুর রহমান খান মর্যাদা সম্পর্কে কতটা সচেতন এবং আমৃত্যু তিনি এই মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতে দেন নি।
হাবিবুর রহমান খান একজন কুশলী সাংবাদিক ছিলেন। তাঁকে সাংবাদিকদের শিক্ষক বলাই ভালো। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে তাঁর অনেক ভাবনাচিন্তা ছিলো। সংবাদপত্রের খুঁটিনাটি নানা বিষয়ে তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর জানার মধ্যে কোনো ফাঁক ছিলো না। তিনি যা’ জানতেন তা’ সম্যকভাবেই জানতেন। সংবাদপত্রের ব্যাকরণ তাঁর নখদর্পণে ছিলো। আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন, তখন তাঁর সৃজনশীলতা প্রকাশ পেত। সাংবাদিকতায় তিনি আমার গুরু সে কথা বলেছি, তাছাড়া তিনি ছিলেন সম্পর্কে আমার নানা। সে কারণে তাঁর খুব কাছাকাছি যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। শেখাতে তাঁর কোনো ক্লান্তি ছিলো না, সাংবাদিকতার এই শিক্ষকের মৃত্যুতে চট্টগ্রামের সংবাদপত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সংবাদপত্রের গেট-আপ-মেকআপের এক নিপুণ শিল্পী ছিলেন তিনি। ধীর স্থির শান্ত মেজাজের রাশভারি মানুষটি অফিসে আসার পর কাজে ডুবে যেতেন। লিখছেন, একের পর এক কপি দেখে দিচ্ছেন, শিরোনাম দিচ্ছেন, সবশেষে যখন ডামি করতে বসতেন, তখন তিনি অন্য মানুষ হয়ে যেতেন। কী যে অপরিসীম ধৈর্য, অখন্ড মনোযোগ, নিবিড় নিষ্ঠায় তিনি ডামি করতেন। (বাকী অংশ আগামীকাল)
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
ছাপানো কোনো ডামি শিট তাঁর ছিলো না। চিত্রকর যেমন তুঁলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন এক একটি শিল্পকর্ম, তেমনি হাবিবুর রহমান খানও ফুল স্কেপ সাইজের কাগজে রুল টেনে টেনে যে ডামি করতেন, সেটিও তাঁর শিল্পিত হস্তের আঁকিবুকিতে হয়ে উঠতো অনবদ্য এক সংবাদ-শিল্পকর্ম। ফার্স্ট লিড, সেকেন্ড লিড, বটম লিড-নিউজ ট্রিটমেন্টের এসব টেকনিক তাঁর কাছেই আমি শিখি। পরে পূর্বকোণে কে জি সাহেবের কাছে শিখলাম থার্ড লিড, নেক আর লেগ আইটেম, উইথ, অ্যাড-এসব সংকেতায়ন। পূর্বকোণের প্রথম নির্বাহী সম্পাদক মীর নুরুল ইসলামের কাছে শিখলাম ন্যারো পেস্টিং করে ডামি তৈরি আর ছোট ছোট জায়গা সৃষ্টি হয়ে মেক আপের সময় সংকট দেখা দিতে পারে এমন আশংকা থেকে শিফটের কাজ চলার সময় ফিলার আইটেম তৈরি করিয়ে রাখা ইত্যাদি।
হাবিবুর রহমান খানের একটি শিরোনাম এখনো আমার মনে আছে। কোনো রিপোর্টার, সম্ভবত তালাত মাহমুদ বউ বাজারের বগার বিলের বস্তির মানুষদের জীবনযাত্রা ও তাদের সংগ্রামী জীবনের ওপর একটি ফিচারধর্মী রিপোর্ট নিয়ে আসে। খান সাহেব সেটি মেরামত করে শিরোনাম দিলেনÑ ‘বগার বিলে ওরা জীবনের নৌকা বেয়েই চলে।’ তিন দশক পরেও এই শিরোনামকে পুরোনো বলে ‘আধেক আঁখির কোণে’ কটাক্ষ হেনে খারিজ করে দেবার উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা। পাকিস্তান আমলে সমবায় দপ্তর থেকে ‘সমবায়’ নামে সংস্থার একটি মুখপত্র প্রকাশিত হতো। একবার ওই পত্রিকার সম্পাদক পদে নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। হাবিবুর রহমান খান এই চাকরির জন্য আবেদন করেন। কর্তৃপক্ষ আবেদনকারীদের ইন্টারভিউতে ডাকেন। হাবিবুর রহমান খান ইন্টারভিউ দেন। ঢাকা থেকে কবি-সাংবাদিক-কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীও ইন্টারভিউ দেন। ইন্টারভিউর ফল বের হলে দেখা গেল হাবিবুর রহমান খান নির্বাচিত হয়েছেন।
গাফফার চৌধুরী সম্পাদকীয়, মন্তব্য, প্রবন্ধ রচনায় সিদ্ধহস্ত; পক্ষান্তরে হাবিবুর রহমান খান ছিলেন টেকনিকালি সাউন্ড-কপি সম্পাদনা, শিরোনাম রচনা, পৃষ্ঠা সজ্জা ও অঙ্গসজ্জার নিপুণ কারিগর। সমবায় কর্তৃপক্ষও চেয়েছিলেন সংবাদপত্রের সামগ্রিক বিষয়ে জ্ঞান রাখেন এমন একজন সাংবাদিক। অতএব, হাবিবুর রহমান খানই তাঁদের বিবেচনায় উক্ত পদের জন্য উপযুক্ত সাব্যস্ত হলেন।
হাবিবুর রহমান খান তখন আজাদীতে কাজ করছেন। তিনি উক্ত চাকরিতে যোগদানের জন্য তৈরি হচ্ছেন, এমন সময় একদিন বিশিষ্ট সাংবাদিক, অবজারভার-এর বার্তা সম্পাদক এ বি এম মূসা তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে একদিন আন্দরকিল্লায় আজাদীর পুরোনো অফিসে যান। কুশল বিনিময়ে পর তিনি সরাসরি প্রসঙ্গে এসে বললেন, আপনি সমবায় পত্রিকার চাকরির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। আপনার তো একটি চাকরি আছে। কিন্তু আপনার পেশার একজন লোক যদি বেকার হন এবং তাঁর যদি এই চাকরিটা ভীষণ প্রয়োজন হয়, তাহলে আপনি কী তাঁর জন্য চাকরিটা স্যাক্রিফাইস করবেন না? মূসা সাহেব বললেন, আমি গাফফার চৌধুরীর কথা বলছি। সে এখন বেকার, তার এই চাকরিটা খুব দরকার। আমরা ঢাকার সবাই আপনার কাছে এই অনুরোধ রাখছি, আপনি এই চাকরিতে জয়েন না করুন। আপনি না গেলে গাফফার চৌধুরী চাকরিটা পাবেন। খান সাহেব আর কি করেন। মূসা সাহেব এত করে বলছেন। ঢাকার সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এসেছেন। তাঁদের অনুরোধ না রেখে উপায় কি। তাছাড়া মূসা সাহেব তখন পূর্ব পাকিস্তান জার্নালিস্ট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। খান সাহেব আর সেই চাকরিতে গেলেন না। তাঁর মুখেই এসব কথা শোনা।
হাবিবুর রহমান খান চট্টগ্রামে না করে ঢাকায় সাংবাদিকতা করলে নিঃসন্দেহে দেশের অন্যতম সেরা সাংবাদিক হিসেবে পরিগণিত হতেন। ইংরেজি, বাংলা, দু’ ধরনের পত্রিকাতেই তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। দু’ ভাষাতেই তাঁর বেশ ভালো দখল ছিলো। যার ফলে ইংরেজি ইস্টার্ন এক্সামিনার কিংবা ডেইলি লাইফ, স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলা দৈনিক আজাদী কিংবা আজান, স্বাধীনতা-উত্তর দৈনিক নয়াবাংলা অথবা স্ব সম্পাদিত দৈনিক সেবক-সর্বত্র সমান দক্ষতায় তিনি সম্পাদনা করে গেছেন। তিনি দৈনিক আজাদী’র প্রথম বার্তা সম্পাদক-১৯৬০ থেকে ৬৩, সম্ভবত তিন বছর তাঁর প্রতিভার জাদুস্পর্শে আজাদীর শিকড় এমন দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রোথিত হয় যে, ৫৬ বছর পরেও আজাদীকে কেমন তরতাজা, যৌবনের প্রাণশক্তিতে ভরপুর পত্রিকাই মনে হয়। তাঁর মতো এমন সুদক্ষ বার্তা সম্পাদক চট্টগ্রামে আর জন্মাবে কিনা সন্দেহ। তাঁরও তো তখন বয়স কম, নব যৌবনের শিহরণ তাঁর শিরায় শিরায়; পাক জমানায় চট্টগ্রামের প্রথম দৈনিক এবং চট্টগ্রামের প্রথম আধুনিক সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেই নবীন যুবক হাবিবুর রহমান খান নিশ্চয়ই কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন।
সঙ্গত কারণেই আমি একথা বলছি। সাহেবদের আমলে ‘জ্যোতি’, ‘পাঞ্চজন্য’, ‘দেশপ্রিয়’, ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ইত্যাদি পত্রিকা প্রকাশিত হলেও এবং ভারত থেকে আসা মোহাজের সাংবাদিকদের সম্পাদনায় পাক জমানার প্রথম দশকে ‘ইস্টার্ন এক্সামিনার’, ‘ইউনিটি’ ইত্যাদি ইংরেজি দৈনিক প্রকাশিত হলেও সুসংগঠিত বাংলা দৈনিক ওই আজাদীই। তার আগে মাহবুব-উল-আলমের জমানা বেরিয়েছিল। কিন্তু আজাদীর মত অত আঁটঘাট বেঁধে সর্বাঙ্গীণ প্রস্তুতি নিয়ে মনে হয় জমানার প্রকাশ ঘটেনি। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক প্রথম ইলেকট্রিক প্রিন্টিং মেশিন আমদানি করে আইয়ুবের মার্শাল ল’র মধ্যে যে দৈনিকটি প্রকাশ করলেন সেটি ইতিহাস হয়ে গেল। অতঃপর কাঠামোগত শৃঙ্খলার মধ্যে সংবাদপত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করার পালা। ডেস্ক, রিপোর্টিং, এডিটোরিয়াল, রিডিং ইত্যাদি নানা দিকে বিন্যস্ত হয়ে সংবাদপত্র একটা গোটা অবয়ব নিয়ে দানা বেঁধে উঠতে থাকলো। বলা যায় সুসংবদ্ধ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ আজাদী; হাবিবুর রহমান খান যার নির্মাতা। এত সাব-এডিটর, রিপোর্টারের ছড়াছড়ি তখন ছিলো না। হাবিবুর রহমান খান এক শস্ত্রগুরু, যিনি ধরে ধরে হাতে কলমে কাজ শিখিয়ে তৈরি করেছিলেন রিপোর্টার, সাব-এডিটর। সাংবাদিক সৃষ্টির মাধ্যমে আজাদী হাউজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হাবিবুর রহমান খান যে দক্ষ সেনাপতির ন্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আজাদীরই এক প্রাক্তনী, সম্ভবত চিফ সাব এডিটর কাজী জাফরুল ইসলামের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে তার প্রমাণ হাজির করছি। আজাদীর বার্তা সম্পাদক সাধন কুমার ধরের মৃত্যুর পর প্রকাশিত একটি স্মরণিকায় কাজী জাফরুল ইসলাম তাঁর আজাদীতে যোগদানের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লিখছেনÑ ‘….আমাকে খালেদ সাহেব (অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, পরবর্তীকালে আজাদী সম্পাদক) ঐ-দিন পরিচয় করিয়ে দিয়ে হাবিব ভাইকে (হাবিবুর রহমান খান) বললেন, আপনি আমাদের যেভাবে গড়ে নিয়েছেন, এঁকে সেভাবে গড়ে নেবেন’ (স্মরণের আবরণে : ৯ জুন ২০০৪)। হাবিবুর রহমান খান তাঁদেরকে গড়ে তুলেছিলেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের এই উক্তির মধ্যেই আজাদী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হাবিবুর রহমান খানের অবদান প্রমাণিত হয়ে যায়।
আরো একটু আগের কথা বলতে যেয়ে প্রথিতযশা সাংবাদিক, কলামিস্ট, শিল্পী মঈনুল আলম চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার যে চিত্র এঁকেছেন, তা’ এখানে উদ্ধৃত করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। তিনি লিখেছেন, ‘….তখন চট্টগ্রামে সাংবাদিকতার এতটুকু শেখানরও মানুষ ছিল না। ১৯৪৭ সালের আগে পর্যন্ত সাংবাদিকতায় চট্টগ্রামের ঐহিত্য থাকলেও দেশ বিভাগের পর পরই চট্টগ্রামের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র শিল্প যেন মুষড়ে পড়েছিল।’ (কলমের সৈনিক, পৃ. ৩০ : ২০১২)
মঈনুল আলমের আক্ষেপ পঞ্চাশের দশক নিয়ে; ষাটের দশকে এই অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটে। কারণ ততদিনে চট্টগ্রামের সংবাদপত্র জগতে সাংবাদিকতা শেখানোর দু’একজন সাংবাদিক এসে গেছেন। একজন তো অবশ্যই হাবিবুর রহমান খান। আরো কেউ থাকতে পারেন, কিন্তু তিনি বা তাঁদের কথা আমি জানি না। মঈনুল আলম সাহেবের বই পড়ে আমি জেনেছি, মোহাজের সাংবাদিক জাফর আহমদ জাবেদ এমনি সাংবাদিক তৈরির কারিগর ছিলেন।
হাবিবুর রহমান খানের সাংবাদিক জীবনের একটা পরিচয় দেয়া দরকার। কিন্তু তিনি কখন কোথায় কতদিন ছিলেন সে সম্পর্কে আমি সম্যক জ্ঞাত নই। আজাদী ও ইস্টার্ন এক্সামিনারের কথা বলেছি। তিনি আজান-এর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন, ডেইলি লাইফের বার্তা সম্পাদক আর নয়া বাংলার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। ববি সাহেবের ডেইলি লাইফে যখন তিনি বার্তা সম্পাদক, তখন সেখানে নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত লেখক, সাংবাদিক, সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক। তিনি কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট আবুল মোমেন, আইনজ্ঞ অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত, এবং সাংবাদিক (পূর্বকোণের সাবেক চিফ রিপোর্টার) মোহাম্মদ বেলালকে সেখানে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত করেছিলেন।
আজাদী প্রসঙ্গ দিয়েই হাবিবুর রহমান খানকে নিয়ে এ লেখার উপসংহার টানতে চাই। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর আজাদী প্রকাশিত হয়, তার দু’মাসের মধ্যে ৩০ অক্টোবর প্রচÐ ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম লÐভÐ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় পরদিন কোন পত্রিকা প্রকাশিত হতে পারে নি। ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সংবাদও মানুষের অগোচরে থেকে যাবার কথা ছিলো। কিন্তু নবীনতম পত্রিকা আজাদীর কাÐারী হাবিবুর রহমান খান বিদ্যুৎ বিহীন প্রেসে স্টাফদের নিয়ে হাত দিয়ে মেশিন ঘুরিয়ে আজাদী প্রকাশ করেন। ঘূর্ণিঝড়ের সংবাদ পত্রিকায় পাঠ করে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। একটি পত্রিকার জন্য এটি বিরল কৃতিত্ব।
আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তাঁর প্রিয়তম কন্যার নামে একটি মাসিক পত্রিকা, প্রিন্টিং প্রেস এবং একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখন যেখানে চৌরঙ্গী রেস্তোরাঁ, তার দক্ষিণ পাশে ছিলো কোহিনূর লাইব্রেরী। সেই লাইব্রেরী যিনি দেখাশোনা করতেন, তাঁর নাম সম্ভবত আলতাফ সাহেব। সেখানে নিত্যদিন আড্ডা জমতো। হাবিবুর রহমান খান সময় পেলে সেই আড্ডায় গিয়ে বসে থাকতে ভালোবাসতেন। প্রফেসর সাহেব, মালেক সাহেব, ইউসুফ গণি সাহেব এবং সাবেক কমিশনার গোলাম মোস্তফা কাঞ্চন সাহেব সেখানে নিয়মিত হাজিরা দিতেন। প্রবীণ প্রফেসর সাহেব ও তাঁর বন্ধু লন্ডন শামসু (ডা. শামসুল আলম, তাঁর পুত্র কানাডা প্রবাসী আবদুস সালাম ২১ ফেব্রæয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি আদায়ের প্রধান উদ্যোক্তা), মওলানা এ আর চৌধুরী, মওলানা আবু তাহের, প্রবীণ নেতা গোরা আজিজ, আলিমুল্লাহ চৌধুরী, ডা, জাকেরিয়া চৌধুরী, সাধন বাবু, শরীফ রাজাÑএঁরাও কি কোহিনুর লাইব্রেরীর ‘কোহিনূর-রতœ’ ছিলেন?
সাংবাদিক হাবিবুর রহমান খানের জন্ম ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার কাশিয়াইশ ইউনিয়নের (বর্তমান বরলিয়া ইউনিয়নের) ওকন্যারা গ্রামের খান বাড়িতে। তিনি পটিয়ার খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব ছৈয়দ খান (রা.) এর বংশধর। তাঁর পিতা মরহুম আজিম উল্লাহ্ খান ও মাতা মরহুমা আছিয়া খাতুন। ৩ ভাই ৫ বোন এর মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ভাইবোন ক্রমান্বয়ে-১. মরহুমা রাবেয়া খাতুন, ২. মরহুম হাবিবুর রহমান খান, ৩. মরহুমা হোসনে আরা বেগম, ৪. মরহুমা মাহবুবুর রহমান খান, ৫. মুজিবুর রহমান খান।
সাংবাদিক হাবিবুর রহমান খান ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ওকন্যারা গ্রামের অছি মিঞা খানের কন্যা লুৎফুন নাহার খানমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৪ ছেলে ১ মেয়ের জনক ছিলেন। বড় ছেলে রাজ্জাকুল হায়দার খান, পেশায় চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, বর্তমানে ইংল্যান্ড প্রবাসী। একমাত্র মেয়ে নাসরিন সুলতানা খানম, উন্নয়ন সংগঠক। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রাইট বাংলাদেশ ফোরামের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মেজ ছেলে শাহেদ হায়দার খান ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ।সেজ ছেলে ইরফান হায়দার খান ব্যাংকার। সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন স্টান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে। ছোট ছেলে ইমরান হায়দার খান বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। শৈশবে পটিয়া থানার বরলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাবিবুর রহমান খানের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন পটিয়ার কর্তালা বেলখাইন মহাবোধি উচ্চ বিদ্যালয় ও চট্টগ্রামের গোসাইলডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে।গোসাইলডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
পঞ্চাশের দশকে শিক্ষকতা পেশা দিয়ে হাবিবুর রহমান খান এর কর্মজীবন শুরু হয়। শুরুতে তিনি পটিয়ার দৌলতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর শিক্ষকতা করেন পটিয়া এ জে চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাথেও তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এরপর তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন পটিয়ার কর্তালা বেলখাইন মহাবোধি উচ্চ বিদ্যালয়ে।
প্রায় দশ বছরের মতো শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার পর তিনি ষাটের দশকের শুরুতে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। সেই সময় শিক্ষকতার মতো সাংবাদিকতায়ও আর্থিক স্বচ্ছলতা ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার অভাব ছিল। সব জেনেও ত্যাগী, দানশীল মনোভাব ও নৈতিক আদর্শকে ধারণ করে তিনি সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ন্যায়পরায়ণ, নির্ভীক, নির্লোভ, নির্মোহ, সৎ চরিত্রের জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব হিসেবে খ্যাতি ছিল ক্ষণজন্মা এ মানুষটির। ন্যায়-নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। শত প্রতিক‚ল অবস্থার মধ্যেও অন্যায়ের কাছ হার মানেননি কখনও। তিনি ছিলেন জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ।
হাবিবুর রহমান খান চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। তৃতীয় শ্রম আদালতের জুরী বোর্ড এর সম্মানীত সদস্য ছিলেন তিনি। সাংবাদিকতা পেশা ছাড়াও শিক্ষা, সমবায় ও শ্রম আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হিসেবেও তাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিল।
হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিশেষ ভ‚মিকা ছিলো। এই কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি কলেজের সাংগঠনিক কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে অবদান রেখেছেন। নিজের গ্রামে ওকন্যারা গাউছিয়া তৈয়্যবিয়া সুন্নীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও নামকরণে তিনি উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখেন। এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষামূলক ও সামাজিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ও পথ চলায় নানাভাবে সম্পৃক্ত থেকে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক











