আনোয়ারা প্রতিনিধি
কর্ণফুলী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) হাতি চলাচলের করিডোর। তাই সেখান থেকে সরিয়ে নয়, সেখানে রেখেই এসব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সুপারিশ গবেষকদের। তাঁরা বলছেন, কেইপিজিড করার সময় পরিবেশগত সমীক্ষা প্রকাশ হয়নি। এর ৫২ ভাগ এলাকা বন্যপ্রাণীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। সম্প্রতি কেইপিজেডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কেইপিজেডের হাতির ভবিষ্যত নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকের সূত্র ধরে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনের উপায় নিয়ে ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ টিম করেছে সরকার। গতকাল তারা স্থানান্তর না করে খাবারের সংকট মিটিয়ে ক্যামেরা ও জিপিএস ট্র্যাকিংয়ে পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছে সরকারকে। আগামিকাল জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম সরেজমিনে দেখতে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কথা বলতে আনোয়ারায় যাবেন বলে জানা গেছে। তিনি এসময় সাধারণ মানুষকে সচেতন এবং ক্ষয়ক্ষতি কমাতে নানা পরামর্শ দেবেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, আনোয়ারার দেয়াং পাহাড় এলাকায় পাহাড়ি বনের দুই হাজার ৪৯২ একর এলাকার ১ হাজার একরজুড়ে এর অবস্থান। এখানে গড়ে উঠেছে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন-কেইপিজেড। বিশেষজ্ঞদের দাবি- এ জায়গাটি ছিল চুনতি ও বাঁশখালীর হাতি চলাচলের করিডোর। গত ৫ বছর ধরে সেখানে আবাস গড়েছে ছোটবড় ৪টি হাতি। হাতি গুলোর সাথে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বেড়েছে দ্ব›দ্ব, গত ৫ বছরে ঝড়েছে ১৭ জন মানুষের প্রাণ। আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত মানুষ। ক্ষেত খামার বাড়িঘর নষ্ট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বহু মানুষ।
কেইপিজেড করার আগে পরিবেশ সমীক্ষায় বলা হয়, বনভ‚মির ৩৩ ভাগে সবুজায়ন ও ১৯ ভাগ থাকবে মুক্তবনাঞ্চল। যেখানে অবাধে বিচরণ করবে হাতির দল। তবে সম্প্রতি সেখানে উজার হচ্ছে বন। পাহাড় নিধন করা হয়েছে নির্বিচারে।
কেইপিজেডের ভাষ্য তারা সেখানে লক্ষ গাছ রোপন করেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- এসব জাতের গাছ পরিবেশের কোনো উপকারে আসেনা বরং ক্ষতি করে। তাছাড়া এসব গাছে কোনো ফলমূল না থাকায় বন্যপ্রাণীদের খাবারের যোগান হয় না। অথচ সরকার ১৯৯৬ সালে কেইপিজেডকে একটি ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন হিসেবে লাইসেন্স দিয়েছিল। যার ৫২ ভাগ থাকবে বণাঞ্চল এবং বাকী ৪৮ ভাগে ইন্ডাস্ট্রি করা যাবে।
চট্টগ্রাম বন বিভাগের বন সংরক্ষক মোল্ল্যা রেজাউল করিম বলেন, ‘পরিবেশ পরিস্থিতিকে উনারা কো এক্সিসটেন্স বা একসাথে চিন্তা করছেন না। উনারা শুধুমাত্র তাদের বাণিজ্যিক বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থের বাইরে যেতে চাচ্ছেন না’। কেইপিজিড এর ৫২ ভাগ এলাকা বন্যপ্রাণীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ‘ইআই এর রিপোর্ট তারা ডিসক্লোজ করতে চান নাই। আমি অনেববার ওনাদের সাথে যোগাযোগ করেছি, চিঠি দিয়েছি, কিন্তু করেননি’।
এখনই এই হাতিদেরই সরিয়ে নিতে বলছে কেইপিজেড ও স্থানীয়রা। তবে গবেষকেরা বলছেন, হাতির বসতিতেই হয়েছে শিল্পাঞ্চল। সংকুচিত বিচরণ ভূমি ও খাবার সংকটেই বাড়ছে মানুষের সঙ্গে সংঘাত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘কেন হাতির আবাসযোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠানটি করা হলো! তার মানে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হয়নি। সল্ট লিকিংয়ের জন্য যদি আমরা কিছু সল্ট আধার কিছু তৈরি করে দিতে পারি তাহলে সমাধান অনেকটা সম্ভব। পাশাপাশি হাতিরা যেসব খাবার খাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করার চেষ্টা করে, সেই খাবারগুলো ওর মধ্যে দিতে পারি তাহলে হাতি ক্ষতি করবে না।’
তাছাড়া ‘ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যে সিস্টেম আছে সেটা যদি তড়িৎ বেগে দেওয়া যায়, তাহলে মানুষ অনেকটা প্রশমিত থাকবে। তারা জানবেন যে, আমার সম্পদের ক্ষতি হলে সরকার এটা পূরণ করে দেবেন।’
কেইপিজেডের উপ ব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান বলেন, মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির একটি সুপারিশ জমা দেওয়ার বিষয়টি আমি দেখেছি। আরেকটি ছয় জনের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে আমাদের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। আসলে হাতিগুলো নিয়ে আমাদের কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে সকলে অনেক আতঙ্কের মধ্যে আছে। গতকালকেও হাতিগুলো প্রধান সড়কে অবস্থান নিলে শ্রমিকরা প্রায় দুই ঘন্টা আটকা পড়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেইপিজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লে. কর্ণেল মো. শাহজাহান (অব.) বলেন, বিশেষজ্ঞদের সুপারিশের বিষয়ে আমরা এখনো কিছু জানিনা। বিষয়টি আমরা অবগত হয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব।